পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৩৩

জহির রায়হান ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। কি প্রচণ্ড পরিশ্রমে সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন তা বলা যায় না। একটা বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করা যায়। একদিন হঠাৎ খবর পাওয়া গেল যে ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ছবির একটা প্রিণ্ট কলকাতায় এসেছে। সারাদিন খোঁজার পর পাওয়া গেল সেটি। শেরপুর এলাকার একটি সিনেমা হলের মালিক সাহস করে নিয়ে এসেছেন। মালিক জানালেন এটা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং প্রিণ্ট তিনি দেবেন না। তখন মীমাংসায় বসা হলো। জনাব খায়ের (সংসদ সদস্য) এর দায়িত্ব নিলেন। ষাট হাজার টাক নগদ দেওয়া হল মালিককে। এরপর ঠিক হোল ছবি দেখিয়ে যা আয় হবে তার অর্ধেক পাবে শিল্পীরা আর বাকিটা পাবে এম, সি, এ। জহির রায়হান নিজে কিছুই নিলেন না। মনে রাখা দরকার সবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।

 একই মাসে জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এসে বলেন যে দিল্লীতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হতে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের পক্ষে আমরা যাবো গান শোনাতে। ৩৫ সদস্যের একটি দল নিয়ে আমরা পৌঁছাই। আমাদের অনুষ্ঠান অসাধারণভাবে সফল হয়। মঞ্চ নির্দেশনায় মোস্তফা মনোয়ার আশ্চর্যরকম আবহ সৃষ্টি করেন। সমগ্র অনুষ্ঠান যে কি রকম সাড়া জাগায় তা বলার নয়। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর ভারতীয় গণসঙ্গীতের দুই প্রধান পুরুষ বিনয় রায় এবং জ্যোতিন্দ্র মিত্র মঞ্চে আসেন এবং গান শোনান। সে অভিজ্ঞতা বলার নয়।

 এভাবে আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম বিভিন্ন শিবিরে। একই সাথে চলছিল অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টা। তখন ডিসেম্বর মাস। আমি গেলাম জহির রায়হানের কাছে এই ব্যাপারে আলাপ করার জন্য। তাকে খুব আনমনা মনে হচ্ছিল। আমি কথাটা তুলতেই তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ওয়াহিদ ভাই, এসবের প্রয়োজন হবে না। আমি ১৬ তারিখে ঢাকায় যাচ্ছি।’ আমি এই কথার কোন কিছুই বুঝলাম না। কারণ, দেশ যে মাত্র কদিন পরই স্বাধীন হবে ভাবিনি। যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে দেশ স্বাধীন তখন আমি নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে ছিলাম। আনন্দে যে কি করেছি তা বলার নয়। ১৬ তারিখেই দেশ স্বাধীন হয়। সেদিনের কথা জহির রায়হান বলেছিলেন দু’সপ্তাহ আগে।

ওয়াহিদুল হক
মার্চ, ১৯৮৪


কণিকা বিশ্বাস

 ২৫শে মার্চ আমি গোপালগঞ্জ মহকুমার কাশীয়ানী থানার ওড়াকান্দি গ্রামে ছিলাম এবং সেখান থেকেই পাক বর্বরদের অমানুষিক নির্যাতনের সংবাদ জানতে পারি। জুলাই মাসের শেষ ভাগে ভারত আগমনের পূর্বপর্যন্ত গোপালগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করি এবং আওয়ামী লীগ কর্মী ও যুবকদের সংগঠনের চেষ্টা করি। মে মাসের মধ্যেই আমরা বেশ শক্তিশালী হই এবং ৫ই মে গোপালগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আমরা গোপালগঞ্জ থানা আক্রমণ করি। গোপালগঞ্জ থানা ইনচার্জ নিহত হয় এবং থানা থেকে ৮২টি রাইফেলসহ বহু গোলাবারুদ উদ্ধার করি। প্রথম দিকে গেরিলা যুদ্ধে আমরা সুবিধা করতে সক্ষম হলেও মে-র মাঝামাঝি প্রায় হাজারখানেক পাকসেনা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমাদের এলাকায় প্রবেশ করলে আমাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। ১৬ই মে রবিবার পাক সৈন্যরা গোপালগঞ্জ থানার সাতপাড়া গ্রামে একাধারে পাঁচ ঘণ্টা গুলি চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। এখানে ১০৩ জন নিরীহ গ্রামবাসী পাকসেনা কর্তৃক নিহত হয়। ঠাকুরবাড়ীর গর্তে একই পরিবারের ৮ জনকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে।

 ১৮ই মে মকসুদপুর থানার ভেন্নাবাড়ী পাকসেনা কর্তৃক আক্রান্ত হয়। সমগ্র গ্রামে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। ছাত্রলীগ কর্মী অমলকে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে হত্যা করা হয়। ভেন্নাবাড়ী ও রথবাড়ী এই দুই গ্রামের মধ্যের বিলই ছিল হত্যাকাণ্ডের কেন্দ্র। এখানে প্রায় ১৩২ জনকে পাক বর্বররা হত্যা করে। এছাড়া