পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৩৫

:

করেন এবং ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় স্বাধীনতার আহ্বান জানান। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ে অনেকে আশাবাদী হলেও আমরা বলেছিলাম পাকিস্তানী বিজাতীয় শাসক গোষ্ঠী যে কোন অজুহাতে পূর্ব বাংলার জনগণকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে দেবে না। এজন্যই আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার আহ্বান জানাতে থাকি।

 ’৭১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে আমাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। ৭ই মার্চ প্রচারিত এক প্রচারপত্রে আমাদের আহ্বান ছিল, ‘আঘাত হানো, সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করো, জনতার স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েম করো’। মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের খুব আশান্বিত করতে পারেনি—সেদিনই তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে এতে বিপুল রক্তক্ষয়কে এড়ানো যেতো। কয়েকজন সহকর্মীসহ আমি তাঁর সাথে দেখা করে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশ্নে কথা বলি। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমাদের খারাপ ছিল না। তিনি বলেন, ‘তোমাদের গেরিলা যুদ্ধের দরকার নেই, আমি সব ঠিক করে দেবো। ওখানে আমি এখানে তাজউদ্দিন, তারপর দেখবে কি হয়’। এই কথায় স্বাধীনতার প্রশ্নে তাঁকে খুব সিরিয়াস মনে হয়নি—আদৌ তিনি স্বাধীনতার কথা, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাথীনতাকে ছিনিয়ে আনার কথা চিন্তা করেছিলেন কিনা সে ব্যাপারে আমাদের সংশয় ছিল। অথবা এমন হতে পারে যে তিনি তখন ভাবছিলেন বিচ্ছিন্নতার কথা—ক্ষমতায় যাবার পর দাবী করতে না পারলে তিনি হয়তো পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে মুজিবের আলোচনায় আমরা বিরোধিতা করেছিলাম, কারণ সারা পূর্ব বাংলা তখন জ্বলছে একটি মাত্র দাবীতে: স্বাধীনতা। এই পরিস্থিতিতে আমাদের (বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন) উদ্যোগ ২৫ মার্চ বিকেলে পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় সভাপতির ভাষণে আমি স্বাধীনতা সংগ্রামের ১৩ দফা কর্মসূচী তুলে ধরি। এই সভায় আমরা বলেছিলাম, আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য, আর তাই সারাদেশে অবিলম্বে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে হবে। এটাই ছিল তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ পল্টন ময়দানের শেষ জনসভা। সভাশেষে এক প্রকাণ্ড মিছিলযোগে আমরা শহীদ মিনারে যাই এবং সেখানে শপথ গ্রহণ করি। কর্মীদের পাঠিয়ে দেই তাদের নিজ নিজ এলাকায়।

 ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড শুরু করলে আমি আশ্রয় নেই এ দেশের প্রগতিশীল সিনেমা আন্দোলনের পথিকৃত শহীদ জহির রায়হানের বাসায়। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে তিনদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, জহির রায়হানের গাড়িটিও আমাদের দিয়েছিলেন ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য। এই গাড়ী নিয়েই আমরা ঢাকা জেলার শিবপুর চলে যাই সেখানে আমাদের সংগঠনের নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া গড়ে তুলেছিলেন এক বিরাট গেরিলা বাহিনী। উল্লেখ করা দরকার যে জহির রায়হানের গাড়িটি যুদ্ধের গোটা সময়টাতেই শিবপুরে ছিলো এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এটাকে বিভিন্ন কাজে লাগিয়েছিলেন।

 শিবপুরে আমরা নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে নেই। হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেননকে মাওলানা ভাসানীর সাথে যোগাযোগের জন্য টাংগাইল পাঠানো হয়। তাঁরা দেখা করতে পারলেও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ পাননি, কেননা, ৩ এপ্রিলের মধ্যে পাকবাহিনী মওলানা ভাসানীর সন্তোষ এবং বিন্নাফৈরের দুটি বাড়ীই জ্বালিয়ে দেয়। মওলানা ভাষানী আত্মগোপনে চলে যান।

 এদিকে আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল নিজ এলাকা কুমিল্লার চিত্তরায় গিয়ে বাম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। চিত্তরা ভারত সীমান্তের কাছাকাছি ছিলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারি যে, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ইতিমধ্যেই সীমান্ত অতিক্রম করে গেছেন।

 ২৫ বা ২৬ এপ্রিল আমি পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা দেবেন সিকদারের আগরতলা থেকে লেখা একটি চিঠি পাই। ওতে জানানো হয়েছিলো যে, ৩০ এপ্রিল ভারতের জলপাইগুড়িতে মওলানা ভাসানীর