পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৩৯

গিয়েছিলাম। মাও সে তুঙের চিন্তাধারা প্রেরণার অন্যতম উৎস হলেও যুদ্ধকালে গণচীনের ভূমিকার আমরা তীব্র সমালোচনা করেছিলাম। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ছিল আমাদের ঘোষিত শত্রু। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিশেষ করে ভারতের সাহায্যকে আমরা স্বাগত জানালেও সে প্রশ্নে আমাদের সন্দেহ ছিল, সংশয় ছিল। আমরা কোনো পর্যায়েই চাইনি যে ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিক। ভারতের বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন বিশেষ করে মার্কসবাদী কমিউনিষ্ট পার্টির সহযোগিতা আমাদের উপকারে এসেছে। এই সাহায্য ছিল প্রধানত নৈতিক। অনেক সময় তাঁরা আমাদের আশ্রয় এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাঁদের সাহায্যের ফলে শত্রুর হামলার কবল থেকে আমাদের জীবনও বেঁচে গেছে।

 যুদ্ধ চলাকালে বেশ কয়েকবার আমার সাথে বাঙালী সামরিক অফিসারদের বিশেষ করে মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর আবুল মঞ্জুরের বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল। আলোচনাকালে আমি তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একাংশের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিক্ষোভ লক্ষ্য করেছি। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। ভারতের সেনাবাহিনীর অযাচিত হস্তক্ষেপও তাদের ক্ষুব্ধ এবং নিরুৎসাহিত করতো বলে মনে হয়েছে। জুনের শেষে বা জুলাই-এর প্রথমদিকে একদিন জিয়া আমাকে সাথে নিয়ে জীপ চালিয়ে ধর্মনগর থেকে করিমগঞ্জ গিয়ে ফিরেছিলেন। চারশ’ কিলোমিটার পথে প্রায় সাতে সাত ঘণ্টাব্যাপী আলোচনাকালে তিনি বলেছিলেন: ভারত চায় না যে বাংলাদেশে গেরিলা যুদ্ধ প্রলম্বিত হোক এবং এজন্যই আমার মনে হয় ভারতের সেনাবহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। কারণ ভারত একটি ব্যাপারে ভীত—গেরিলা যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে তার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে থাকবে না।

 মেজর জিয়ার এই আশংকার সত্যতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত হই আগস্ট মাসে। এই সময় কলকাতার একটি হোটেলে আমার সাথে আলোচনা হয় মুজিব বাহিনীর দুই নেতা এবং আমার এককালীন বন্ধু ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের। মুজিব বাহিনী গঠনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলেছিলেন: আমরা নিশ্চিত নই যে মুজিব বেঁচে আছেন কিনা, কিংবা তিনি জীবিত অবস্থায় ফিরে আসবেন কিনা। যদি না আসেন তাহলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তার জন্যই মুজিব বাহিনী—যাতে (পরিহাসচ্ছলে) তোমরা কিংবা সামরিক বাহিনীর কোনো বাঙালী অফিসার সে শূন্যতার সুযোগ নিতে না পারে। তাঁদের বক্তব্যে বোঝা গিয়েছিলো যে তাঁরা বেংগল রেজিমেণ্টের কোনো কোনো কমাণ্ডার সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় এবং আশংকায় আছেন।

 ভারতসহ বিদেশে অবস্থানরত বাঙালী প্রগতিশীলরাও আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। বিশেষ করে বৃটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালীরা এ ব্যাপারে ছিলেন বিশিষ্ট ভূমিকায়।

কাজী জাফর আহমদ
মার্চ, ১৯৮৪।


ডঃ কামাল সিদ্দিকী

 ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি আমি নড়াইলে এস, ডি, ও হিসেবে যোগদান করি। নড়াইলে আসার পর বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজকর্মের মধ্যে ম্যাজিষ্ট্রেট-এর দায়িত্ব পালন করা অন্যতম ছিল। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পাকিস্তানী সেনাবহিনীর সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে পড়ে, যেহেতু রাজনৈতিক কর্মীদের আমি সবসময় জামিনে মুক্তি দিতাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এটা চাইত না। এবং তাদের অনুরোধ বা উপরোধ উপেক্ষা করার ফলে তারা আমাকে শুভ নজরে দেখত না। ১৯৭০ সালের সময় আমি নড়াইলেই ছিলাম। এই নির্বাচনকে সৎ নির্বাচন বলা যায় এবং আওয়ামী লীগ সামগ্রিকভাবে সমস্ত আসনে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে জয়লাভ হলেও পরিস্থিতি আমার কাছে ভাল ঠেকছিল না। মার্চের প্রথমদিকে আমি ঢাকায় আসি এবং সামগ্রিক