পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৪০

অবস্থা দেখে আমার এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, পাকিস্তানীদের সাথে আওয়ামী লীগের আলোচনা ব্যর্থ হবে। আমার এ ধারণ একক ছিল না। অনেকেরই এরূপ ধারণা ছিল। ৮ই মার্চ আমি নড়াইলে ফিরে যাই। সেখানেও উত্তেজনা বিরাজ করছিল এবং বিভিন্ন মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালীরা রাজপথে তাদের মনোভাব প্রকাশ করছিল।

 ১১ই মার্চ একটি ঘটনা ঘটে যায়, ফলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। ঐ তারিখে আমি ক্যাণ্টনমেণ্টে কোন কাজে গাড়ি নিয়ে যাই। আমার গাড়িতে কালো ফ্ল্যাগ ছিল। এই ফ্ল্যাগ দেখা মাত্র পাহারারত সৈনিক চীৎকার করে আমাকে নামতে বলে এবং গুলি করতে উদ্যত হয়। গাড়ি থামাবার পর সে আবার বলে কালো পতাকা নামাও। আমি উত্তর দিই যে, কিছুতেই আমি কালো পতাকা নামাবো না। সৈনিকটি তখন বলে কালো পতাকাসহ ক্যাণ্টনমেণ্টে প্রবেশ করা চলবে না। আমি বলি, কালো পতাকা ছাড়া ক্যাণ্টনমেণ্টে আমি ঢুকতে পারি না এবং সেখান থেকেই ফিরে আসি। এ ব্যাপারে আমি প্রেসে একটি বিবৃতি দিই। তোফায়েল আহমদও এই ঘটনার ওপর একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন।

 ২৫শে মার্চ একটি জরুরী কাজে আমি খুলনায় অবস্থান করছিলাম। ২৫শের রাত্রির ঘটনার পর ২৬ তারিখে রূপসা নদী পার হয়ে আমি কালিয়ায় পৌঁছি। সেখানে একটি জনসমাবেশে আমি বক্তৃতা দিই এবং বলি যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের সবাইকে এখন লড়তে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হবার সিদ্ধান্ত ছিল পূর্বপরিকল্পিত। ১৪ই মার্চ ঝিনাইদহে আমরা কয়েকজন সরকারী কর্মচারী মিলিত হই। এর মধ্যে ছিলেন তৌফিক এলাহি চৌধুরী, শাহ ফরিদ, মাহবুব (পুলিশ) এবং অন্য কয়েকজন। এখানে আমরা শপথ নিই যে, প্রয়োজন হলে দেশের জন্য আমরা অস্ত্র ধারণ করবো। ২৭শে মার্চ নড়াইলে ফিরে এসে দেখি যে, অবস্থা বেশ খারাপ। নড়াইল কম-বেশী জনশূন্য এবং লোকেরা অত্যন্ত ভীত। আমি একটি মাইক নিয়ে শহরের রাস্তায় নেমে পড়ি। এবং ৪টায় একটি সমাবেশের আহ্বান করি। এই সমাবেশে আমি ঘোষণা করি, নড়াইল স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য। যেহেতু রেডিওতে শুনেছিলাম জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে সামরিক নেতৃত্ব দান করছেন আমরাও সৈনিক হিসেবে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করি। এই সভাতে কয়েকজন সংসদ সদস্য নিয়ে একটি যুদ্ধ পরিচালনা কাউন্সিল গঠিত হয়। কয়েকজন আনসার এবং সাধারণ মানুষদের নিয়ে সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। মানুষের মাঝে যে কি বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনা ছিল তা বর্ণনা করা যায় না। নিম্নবর্ণের বেশ কিছু হিন্দু শুধুমাত্র তীর-ধনুক নিয়েই এই সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। যশোর এবং মাগুরা থেকে লোকজন এসেও এই গণবাহিনীর সদস্য হয়।

 ২১শে মার্চ প্রায় চার লক্ষ লোকের বিশাল গণবাহিনী যশোর আক্রমণ করে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য পাকিস্তানীদের জন্য যথেষ্ট ছিল। তারা সহজেই বুঝেছিল যে, এই বিশাল জনস্রোতকে সামনাসামনি পরাস্ত করা সম্ভব নয়। এক কথায় তারা ভীতি ছড়িয়ে ছত্রভংগ হয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টে পালিয়ে যায়। বহু পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের হাতে ধরা পড়ে। এখানে উল্লেখ্য যে, এরই মধ্যে তারা লুটতরাজ ও ধর্ষণে লিপ্ত হয়েছিল। বহু বিহারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিল। তাদের অনেকেই আমাদের হাতে মৃত্যুবরণ করে।

 নড়াইলে ফিরে এসে আমরা জনগণকে সংগঠিত করার ভূমিকা গ্রহণ করি। সবাই এগিয়ে এসেছিল যার যা ছিল তা নিয়ে। খাদ্যদ্রব্যের প্রশ্ন তো বাদই দিলাম। জনগণের মধ্যে তখন একটাই ইচ্ছা ছিল এবং সেটি হচ্ছে মার্চ করে আক্রমণ করা।

 কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে এত সহজেই হার মানানো সম্ভব নয়। তারা বিশাল কামান দিয়ে নড়াইলের ওপরে আক্রমণ চালায় এবং আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় তিনশত আনসার কামানের গুলিতে মারা যায়। এছাড়া বিমান বাহিনী প্রায় সারাক্ষণ নড়াইলের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমি অন্যদের সঙ্গে সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষণ করি। এবং সিদ্ধান্ত নিই যে, আমাদের যুদ্ধবন্দীদের বিচার করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন