পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড
১৯৬

অবস্থিত। আমরা হেঁটেই পার হয়ে যাই। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে যায়। ডি, সি-র স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলের এবং তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হন। আমার পরিবারও তাঁর সাথে ঢাকার দিকে রওয়ানা হয়। বাবার ধারণা ছিল সেটাই ভালো হবে। পথিমধ্যে তাঁরা গোপালপুরে এসে জানতে পারেন যে, কারফিউ জারি রয়েছে। রাত্রে ওখানকার থানার ওসি এসে জানায় যে আমার নামে গ্রেপ্তারী পরওয়ানা রয়েছে এবং আমাকে পেলে পাকসেনারা হয়ত সবাইকেই হত্যা করবে। তারা কোন রকমে সেখান থেকে ফিরে আসেন। আমরা আবার সাংগঠনিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। জানতে পারি পাকিস্তানীরা আরিচা পর্যন্ত এসে গেছে। তখন আমরা বগুড়ার উদ্দেশে রওয়ানা হই। এর মধ্যে নগরবাড়ীর পতন ঘটে ১১ই এপ্রিল।

 উল্লাপাড়ায় গিয়ে দেখি বি,ডি,আর-এর সৈন্যরা ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি বগুড়ায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি শহর প্রায় জনশূন্য। হঠাৎ একটা রিক্সায় জনাব গাজিউল হককে দেখি। আরো কিছু অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়। বগুড়া তখনও মুক্ত। এরই মধ্যে পাকিস্তানীদের সাথে দুটো সংঘর্ষ হয়েছে। এখানে সংগ্রাম পরিষদ সব দায়িত্ব পালন করছিল। তবে কতদিন এই প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখা যাবে তা নিয়ে সবাই বিচলিত ছিল। এম, আর, আখতার মুকুলের সাথে দেখা হয় সেখানে। তিনি ঢাকার খবর দিলেন। তিনিও আমাদের সাথে জয়পুরহাটের দিকে রওয়ানা হন। সেখানে আমাদের পরিবারের লোকজনকে রেখে আমরা কয়েকজন ১৬ই এপ্রিল হিলি উপস্থিত হই ভারতীয় সীমান্তে। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোকজনদের সাথেও সেখানে দেখা হয়। অস্ত্রের প্রকট অভাব সহজেই পরিলক্ষিত হয়।

 আমরা সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয়দের সাথে যোগাযোগ করি এবং অস্ত্রের সাহায্য কামনা করি কিন্তু সে সময় কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তাদের কাছে নাকি কোন আদেশ ছিল না আমাদের সাহায্যের ব্যাপারে। অবশ্য আমরা নিজেরাও জানতাম না যে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে।

 এমন সময় খবর এলো যে জয়পুরহাট দিয়ে পাকিস্তানীরা আসছে হিলির দিকে। সেখানে মুকুল সাহেব ছিলেন, খবর পাঠালাম আমার এবং তাঁর নিজের পরিবারসহ হিলি চলে আসেত। কিন্তু খবর পাঠানোর বহুক্ষণ পরও কাউকে না আসতে দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন কিছু লোক এবং অস্ত্র নিয়ে জয়পুরহাটের দিকে যেতে থাকি। পথিমধ্যে পাঁচবিবির কাছে হঠাৎ জীপ গাড়ীর আলো দেখি এবং তারপরই সবা সাথে দেখা হয়। জানতে পারি যে মুকুল সাহেবকে যে কোন কারণেই হোক পাঞ্জাবী বলে সন্দেহ করা হয় এবং অন্যদেরকে বিহারী মনে করা হয়। তাদেরকে থানায়ও নিয়ে যাওয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত ও,সি-র কথায় জনতা তাদেরকে মুক্তি দেয়। রাত ১২ কি: ১০টার দিকে আমরা সীমান্ত পার হই। আমার মানসিক অবস্থা যে কি ছিল তা বলার নয়। ভীষণ মন খারাপ। এভাবে যে দেশ ছাড়তে হবে তা কোনদিন ভাবিনি। তাছাড়া মুজিবনগর সরকারের কোন সংবাদ আমি তখনও জানতাম না।

 মালদহ পৌঁছে ডি, সি-র সাথে দেখা করি। শুনলাম অন্য কয়েকজনও এসেছেন এই পথ দিয়ে। তাঁর কাছে কোন নির্দেশ আসেনি তিবে তিনি আমাকে মুজিবনগর সরকারের সংবাদ দিলেন। পরের দিন মুকুল সাহেবের সাথে কোলকাতায় উপস্থিত হই এবং জনাব নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন ও কামরুজ্জামানের সাথে দেখা করি। তাদের সঙ্গে সরকার গঠন নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। জনাব নুরুল কাদের খানের সাতে কথা হয় এবং আমাদের দুজনকে একটি সরকারের কাঠামো তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। কিছুদিন পর আমাদেরকে সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

 এর কয়েকদিন পরই জনাব হোসেন আলী মুজিবনগর সরকারের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। আমি অর্থ সচিব নিয়োজিত হই এবং দূতাবাসের একটি কক্ষে আমার দপ্তর স্থাপন করি।

 আমাদের অর্থের মূল উৎস ছিল বিভিন্ন ট্রেজারী থেকে লব্ধ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হায় হোসেন আলী সাহেবের নিয়ন্ত্রণাধীন দূতাবাসের টাকাগুলো। একাউণ্ট রক্ষা করার এবং সরকারী অর্থের অডিট করা আমার বিভাগের প্রধান কাজ ছিল।