পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড
১৯৮

সরাসরি কোন যোগাযোগ খুব কমই হতো। লিয়াজোঁ অফিসারের মাধ্যমে আমাদের কাজ সমাধা হতো এবং প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদান করা হতো।

 আমরা জানতাম মুক্তিযুদ্ধে সৈন্যবাহিনীই প্রধান ভূমিকা পালন করবে তবে আমরা একই সাথে সচেষ্ট ছিলাম একটি সক্রিয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। যাতে প্রয়োজনের সময় আমরা একটি কার্যকরী সরকার তৎক্ষণাৎ চালু করতে পারি। প্রায় সব টাকা-পয়সা প্রদান করা হতো চেকের মাধ্যমে। এখানে বলা যায় যে সমগ্র মুজিবনগর সরকারের অধীনে এক হাজারেরও বেশী কর্মচারী ছিল। আমাদের টাকা-পয়সা বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংকেও রাখা হতো- যদিও সরকার হিসেবে আমাদের কোন আনুষ্ঠানিক অস্তিত্ব ছিল না। যুদ্ধ সম্পর্কিত গোপনীয়তা চরমভাবে রক্ষা করা হতো। খুব কম লোকেই জানতো যুদ্ধ কখন শুরু হতে পারে যদিও সবার কম-বেশী একটা ধারণা ছিল যে যুদ্ধ বাধবেই। যেমন আমরা ১৯৭২ সালের বাজেটও প্রস্তুত করি যা পরে প্রয়োজন হয়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের কাছে যে অর্থ ছিল তা আমাদের হিসাবে দু’বছর পর্যন্ত সরকার পরিচালনার জন্য যথেষ্ট ছিল। এরপর অবশ্য নতুন অর্থ সংগ্রহের প্রশ্ন আসতো। আমরা অবশ্যই চাইছিলাম সমস্যার দ্রুত সমাধান। আমাদের মনে হতো যে, মুক্তিবাহিনী একা যুদ্ধ করলে কয়েক বছর লাগবে এবং এ যুদ্ধ ভারতীয় সাহায্য নিয়েই করতে হবে। যদি যৌথ কমাণ্ডের অধীনে যুদ্ধ হয় তবে তা হবে ক্ষণস্থায়ী এবং কম ক্ষয়ক্ষতিপূর্ণ। এটা ছিল যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের ধারণা।

 উপসংহারে বলা যায় সময়টা ছিল একেবারেই বিশেষ ধরনের। নিজেদের শুধুমাত্র সরকারী চাকুরে বলে কখনও মনে হয়নি। আমরা ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের একটি অংশ। কোন কষ্টই বড় কষ্ট ছিল না। কোন ত্যাগের প্রশ্নে ছিল না দ্বিধা। কখনও ভাবিনি আমাদের কি হবে। একটা কথাই কেবল মনে হতো- কাজটা যে করেই হোক সমাধা করতে হবে। তার জন্য যা করার দরকার সবই করতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম অন্য সবার মত।

খন্দকার আসাদুজ্জামান
 মার্চ, ১৯৮৪।


জয় গোবিন্দ ভৌমিক

 ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। আমি তখন ঢাকায় জেলা ও দায়রা জজের দায়িত্বে নিয়োজিত। আমার কোয়ার্টারটা ছিল পুরানো সার্কিট হাউস চত্বরে। আমার বাসার কাছেই কাকরাইলে অবস্থিত সেণ্ট্রাল সার্কিট হাউস। সেখানে স্থাপিত হল পাক বাহিনীর আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার। মিলিটারীর খট্ খট্ পায়ের শব্দে আর বন্দুকের আস্ফালনে বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে।

 ২৬শে মার্চ রেডিও মারফত ফরমান এলো থানায় বন্দুক জমা দাও। পায়ে হেঁটে কাঁপতে কাঁপতে বন্দুক হাতে নিয়ে গেলাম রমনা থানায়

 ২৮শে মার্চ সবাইকে ১০টায় নিজ নিজ অফিসে অবশ্য হাজির হতে হবে। পুরানো সার্কিট হাউস চতুর থেকে ঢাকা কোর্টের দুরত্ব আনুমানিক ৪/৫ মাইল। গাড়ী ঘোড়া চলছে না। লোকজন প্রাণের ভয়ে গ্রামাঞ্চলে পায়ে হেঁটে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। পায়ে হেঁটে জীবনকে হাতে নিয়ে আমিও চললাম পুরানো ঢাকার জর্জ কোর্ট চত্বরে অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করতে। আমার সঙ্গে ছিলেন আমারই ব্যাচমেণ্ট তৎকালীন ঢাকাস্থ এডশনাল জেলা জজ আতিয়ার রহমান সাহেব। আমরা আদালত প্রাংগনে প্রবেশ করতে সংক্ষম হয়েছিলাম বহু কষ্টে কারণ, দারোয়ান বা নাইট গার্ডরা প্রাণভয়ে কোথায় যে পালিয়েছে তার ঠিকানা নেই। তৎকালীন নেজারত থানায় আগুন লাগান হয়েছে। ফলে অনেক মূল্যবান দলিল পুড়ে গেছে। পশ্চিম দিকের তিন তলা ইমারতটি, যেখানে কিছুদিন আগেও সাময়িকভাবে জজ সাহেবের এজলাস বসত, সেখানে নীচতলায় মিটি মিটি আগুন