পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২০০

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড একটা লঞ্চ আসছে। তাতে লোক ভর্তি, স্থান হবে না। লঞ্চটি তীরে ভিড়লো না। আমরা একটা ছোট ডিঙ্গিতে উঠে আস্তে আস্তে লঞ্চের কাছে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে কোন মতে শরীরকে ঢুকিয়ে দিয়ে ক্যাবিনের ভেতরে প্রবেশ করলাম। রাত ৮-৩০ মিনিট নাগাদ যখন কুমিল্লা জেলার রামচন্দ্রপুর আসলাম, তখন লঞ্চের সারেং বলে উঠলো, যারা হিন্দু আছেন তারা যেন সেখানে নেমে যান। তাদেরকে আর নেয়া যাবে না। তখন অনেকে সেখানে নেমে গেল। আমরা নামলাম না, কারণ আমরা তো হিন্দুর পরিচয় দিচ্ছি না। যখন রামকৃষ্ণপুর পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে ন'টা। একটি বন্দরের মত জায়গা। সর্বত্র গভীর নিঝুম অন্ধকার। দু’একটা কুপি বাতি দোকানের মাঝখান থেকে জ্বলছে। আমরা নেমে পড়লাম। খোকন মিয়া আমাদেরকে গাইড করছেন। আমরা সবাই ভয়ে কাঁপছি। কিন্তু খোকন মিয়া আশ্বাস দিয়ে বলে উঠলেন, কোন ভয় নেই। একটা বুড়ো মাঝিকে ডেকে বললেন ‘এই মাঝি, কামাল্যা গ্রাম চেনো? ঐ গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে যাব, তাদের ইষ্টি কুটুম ঢাকা থেকে এসেছেন।’ সে কুমিল্লা জিলার কামাল্যা গ্রামের চৌধুরী বাড়ী চেনে।

 আমাদের নৌকার ছৈ-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে মাঝি নৌকা বেয়ে চললো। সামনে একটা কুপি বাতি জ্বলছে টিপ টিপ্ করে। ভয়ে আমরা জড়সড়। কখন যে ডাকাতের পাল্লায় পড়ি। দু'একটা হাঁকডাকও কানে গেলো। কিন্তু আমরা নিশ্চুপ।

 যখন কামাল্যা গ্রামে এসে পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় ১টা। ক্ষিধেয় আধমরা হয়ে গেছি। চৌধুরী বাড়ী গিয়ে উঠলাম। খোন মিয়া কানে কানে বলে দিল, ঢাকার জজ সাহেব। একটা অল্প বয়সী ভদ্রমহিলা সেই রাতেই আমাদের জন্য দুটো ডাল-ভাত রেঁধে দিলেন। আমরা পরম তৃপ্তির সাথে তা খেলাম। রাত ভোর হতে বেশী বাকী ছিল না। আমরা একটা ভাংগা বেড়ার ঘরে আশ্রয় নিলাম এবং কোন মতে একটু চোখ বুজলাম। পরদনি যাব, কিন্তু কোন নৌকা মিললো না। তাই সেদিন কামাল্যা গ্রামেই থাকতে হল। খুব ভোরে রওয়ানা হব। কিন্তু খোকন মিয়ার তাগিদ নেই। তিনি গ্রামে কানাঘুষা শুনেছেন, আমরা হিন্দু, কয়েক সের সোনাদানা এবং বহু টাকা পয়সা নিয়ে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছি। কিন্তু এ খবর তিনি চেপে গেছেন, যাতে আমরা ঘাবড়িয়ে না যাই। তিনি শুধু বলে উঠছেন, চা নাস্তা না খেয়ে যাচ্ছি না। যাক, বেলা ৭-৩০ মিঃ দিকে নৌকাযোগে রওয়ানা হলাম আগরতলার দিকে। কিন্তু দু'মাইল পথ না যেতেই আলগি গ্রামে একদল দুষ্কৃতকারী শোরগোল করে ছুটে এলো নৌকার দিকে লাঠি হাতে। আমাদের কাছে যা কিছু টাকা পয়সা সোনাদানা ছিল তা প্রায় লুট হয়ে গেল। এখন উপায়? ঢাকায় ফিরলেও মৃত্যু অবধারিত। তাই এগিয়েই চললাম, সামান্য কিছু পথের সম্বল নিয়ে যা আমার স্ত্রীর কাছে একান্ত গোপনে রাখা ছিল।

 নৌকার মাঝি ৪/৫ মাইল যাবার পর এগাতে সাহস পেল না। সামনে নাকি পাক সেনার আস্তানা। কুমিল্লার একটা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার নিকট নামিয়ে দিল। কিছুই চিনি না। জানলাম, সেখান থেকে মুরাদনগর থানার অধীন বাংগুরা গ্রাম নাকি বেশী দূরে নয়। তখন খোকন মিয়া একই কায়দায় সাহস দিয়ে বলে দিল, কোন ভয় নেই। বাংগুরার চেয়ারম্যান যে তার এক আত্মীয় কতাটা আদৌ হয়তা সত্য নয়। তবু ভরসা পেলাম। তারপর সেখান থেকে ৩/৪ মাইল পথ বহুকষ্টে পায়ে হেঁটে গিয়ে উঠলাম বাংগুরা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের বাসায়। সেখানে আমার পরিচয় গোপন রাখলাম। চেয়ারম্যান সাহেব বয়স্ক মুসলিম লীগ নেতা। তিনি সর্বদা পাকিস্তানের খবর শুনছেন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। আতিথেয়তার ত্রুটি করেননি বিন্দুমাত্র। তাঁর এক ছেলে সেখানকার হাই স্কুলের শিক্ষক। তিনি একটা নৌকা ঠিক করে দিলেন এবং একজন শশ্মশ্রুমণ্ডিত মুরুব্বিমত লোককে সঙ্গে দিয়ে দিলেন যাতে পথে কোন অসুবিধে না হয়।

 সেখানে রাত কাটিয়ে ভোরে রওয়ানা হলাম। কিছুদূর যাবার পর আবার একদল গুপ্তা দ্বারা আক্রান্ত হলাম। কিন্তু ঐ মুরুব্বি লোকটা চেয়ারম্যানের লোক বলায় কোনমতে রক্ষা পেলাম। এমনিভাবে দুর্গম বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করে আমরা কোনমতে পাহাড়ী পথ ধরে ভারত ভূমিতে প্রবেশ করলাম। দেখলাম বহুলোক পায়ে হেঁটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে ভারতে প্রবেশ করছে। ঐ ভারত সীমন্তে আমার পরিচয় দিয়ে নাম