পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২০১

শরণার্থীদের তালিকাভুক্ত করে জীপযোগে রওয়ানা হলাম আগরতলায়, সেখান থেকে ১০/১২ মাইল দূরে। আগরতলায় বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য ক্যাম্প খোলা হয়েছে। অনেক পরিচিত নেতা এবং অফিসারের সাথে দেখা হল। মনে কিছুটা সান্ত্বনা অনুভব করলাম।

 প্রায় ৩ দিন ৩ রাত আগরতলায় ‘বিবেকানন্দ’ হোটেলে কাটিয়ে সকালে রওয়ানা হলাম ধর্মনগরের দিকে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে বাসযোগে প্রায় ১২৫ মাইল পথ অতিক্রম করে এসে পৌঁছলাম ধর্মনগর রেল স্টেশনে। সেখানে জয়বাংলার লোকে লোকারণ্য। সবাই ট্রেনের অপেক্ষায় আছে। রাত ৮টায় ট্রেন ছাড়ে। কোন মতে এক দালালের সাহায্যে জানালার ফাঁক দিয়ে একটা দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় প্রবেশ করলাম। বসবার কোন স্থান নেই। লোকের চাপে জীবন প্রায় যায় যায়। তবু জীবন যায়নি। ঐ ট্রেনে চেপে এগোতে লাগলাম। ‘জয় বাংলা'র কোন লোকই টিকিট কাটে না। আমরাও বিনা টিকিটেই রওয়ানা হলাম। কেউ আমাদের কাছে টিকিট চায়নি। লামডিং ও শিলিগুড়িতে ট্রেন বদল করলাম। ধর্মনগর রেল ষ্টেশন থেকে রওয়ানা হয়ে, তিন দিন তিন রাত ট্রেনে কাটিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছালাম শিয়ালদহ স্টেশনে। মনে হল জীবন ফিরে পেয়েছি। পরে লোকাল ট্রেন ধরে কৃষ্ণনগরে এক আত্মীয়ের বাসায় এসে আশ্রয় নিলাম।

 কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে কলকাতায় এসে আমাদের হাইকমিশন ভবনে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, জয়বাংলার লোকের সমাগম। একজন পরিচিত ভদ্রলোক বললেন, স্যার এসেছেন, শীঘ্র আপনার বায়োডাটা ফরমটা পূরণ করুন। দেখলাম দলে দলে লোক বায়োডাটা ফরম পূরণে ব্যস্ত। আমিও আমার জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ঐ ফরম পূরণের মাধ্যমে রেকর্ড করলাম। পরে আমার পরিচিত খন্দকার আসাদুজ্জামান (প্রাক্তন সি,এস,পি) ও আরও কয়েকজন পদস্থ অফিসার ও এমপি-র সাথে দেখা হল। তাঁরা আমার আগেই এসে মুজিবনগর সরকারের কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। আমাকে দেখে তাঁরা খুব খুশী হলেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের সংকল্প দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করে সে দিনের মত বিদায় নিলাম।

 এক সপ্তাহ পর আবার কলকাতায় আসলাম বাংলাদেশ হাইকমিশন চতুরে। অনেক চেনা মুখ পেলাম এবার। আমাদের দেশের অনেক অফিসার, ডাক্তার, উকিলের সমাগম। সবাই প্রাণের ভয়ে দেশ ত্যাগ করে এসেছেন, অনেকেই চাকুরির আশায় সেখানে ঘোরাফেরা করছেন। একজন ভদ্রলোক আমকে ডেকে বললেন, শীঘ্র আমাদের ট্রেজারী অফিসার জনাব মাখনলাল মাঝির (তৎকালীন ই,পি,সি,এস) সাথে দেখা করুন, আপনি কিছু এলাউন্স পাবেন। পকেট শূন্য। কিছু প্রাপ্তি যোগের কথা শুনে মনটা মেতে উঠলো। গেলাম মাখনলাল মাঝির সাথে দেখা করতে। তিনি বললেন, আমার নাকি ২৫০ টাকা প্রাপ্য। যারা মুজিবনগরে সরকারী চাকুরীতে নিয়োজিত নাই অথচ ‘পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী চাকুরীতে নিয়োজিত ছিলেন তারা সর্বোচ্চ ৫০০ টাকার অর্ধেক (অথবা পূর্বে ৫০০ টাকর কম বেতন পেলে তার অর্ধেক) এলাউন্স হিসেবে পাবেন। তাই তিনি ২৫০ টাকা গুনে আমার হাতে তুলে দিলেন। টাকাগুলি কিন্তু সব পাকিস্তানী মুদ্রায় দেয়া হল। ঐ গুলি ভারতীয় মুদ্রায় বদল করে নিতে হবে। পাকিস্তানী মুদ্রা ও ভারতীয় মুদ্রার হার তখন প্রায় এক পর্যায়েই ছিল। টাকাগুলি ভাংগিয়ে নিয়ে আনন্দিত মনে ফিরে এলাম কৃষ্ণনগরে, যেখানে আমরা আশ্রয় নিয়েছি।

 এখানে বলা প্রয়োজন যে, মুজিবনগর সরকারের হাতে অনেক পাকিস্তানী মুদ্রা জমা পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য। অনেক অফিসার ও সংগ্রামী জনতা পূর্ব পাকিস্তানের অনেক ব্যাংক, ট্রেজারী থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়ে গিয়ে ঐ সরকারের হাতে জমা দেয়। সেই জমাকৃত টাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কিছুদিন অফিসারদেরকে এলাউন্স হিসেবে দেয়া হতো। তারপর মে মাসের মাঝামাঝি কি জুনের প্রথম দিকে, পাকিস্তান সরকার ১০০ ও ৫০০ টাকার পাকিস্তানী নোট অচল ঘোষণা করেন। ফলে মুজিবনগর সরকারের নিকট জমাকৃত প্রচুর নোট অকেজো হয়ে পড়ে।