পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২১৯

 দুনিয়ার শান্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও প্রগতিকামী শক্তি আমাদের স্বাধীনতার বন্ধু এবং অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, মাওবাদী চীন ও দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলরা পাকিস্তানের সমর্থক ও আমাদের স্বাধীনতার শত্রু বলে মূল্যায়ন করা হয়েছিল। এই মূল্যায়ন সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়েছে।

 মে মাসের পরেও মাঝে মাঝে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা করা সম্ভব হয়েছে, যদিও আমাদের কমরেডরা ভারতের তিনটি রাজ্যে ও দেশের মধ্যেও ছড়িয়ে থাকায় তা খুব কষ্টসাধ্য ছিল।

 ভারতের তিনটি রাজ্যেই (পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়) সীমান্তবর্তী শহরে আমাদের পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ক্যাম্প ছিল। দু'ধরনের ক্যাম্প ছিলঃ পার্টির বয়স্ক সদস্যদের পরিবারবর্গসহ এবং যুদ্ধে পাঠানোর জন্য তরুণদের ‘ইয়ুথ ক্যাম্প’।

 দেশ থেকে যাওয়ার সময় আমাদের কমরেডদের সঙ্গে যে যৎসামান্য অর্থসম্পদ ছিল তা-ই ছিল আমাদের প্রাথমিক সহায়। পরে ভারতীয় নাগরিকদের দ্বারা গঠিত সহায়ক সমিতি থেকে আমরা অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য পেয়েছিলাম। আমাদের প্রতিষ্ঠিত কিছু ক্যাম্প আমরা বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মিলিয়ে দিয়েছিলাম। পরে অল্প সংখ্যক ক্যাম্পই আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

 এছাড়া ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকায় প্রবাসী আমাদের পার্টির সমর্থকরা অর্থ সাহায্য সংগ্রহ করে পাঠাতেন। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর নৃশংসতা ও বাঙালীদের সাহসিক যুদ্ধের খবর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে ছাপা হওয়ার পর সারা দুনিয়ায় একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। এ পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের শেষের মাসগুলোতে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য সংগ্রহের কাজটা লণ্ডনে আমাদের কমরেড ও সমর্থকরা সমন্বিত করে আমাদের কাছে অর্থ পাঠাতেন।

 আমাদের ক্যাম্পে সংগঠিত তরুণদের অধিকাংশকেই যেহেতু সরকারী মুক্তিবাহিনীতে পাঠিয়ে দেয়া হত তাই খুব বেশী খরচের বোঝা আমাদের বহন করতে হয়নি। আর আমাদের নিজস্ব গেরিলা বাহিনীর ছেলেরা দেশের ভেতরে এসে জনগণের সহায়তায় আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করতো।

 আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কথা আগেই কিছু বলেছি। সবচেয়ে বড় ঐকমত্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে; সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে তা অর্জনের প্রশ্নে আমরা একমত ছিলাম।

 আমরা আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তির বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলাম। এই প্রচেষ্টা তেমন সফল হয়নি। শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকারের “পরামর্শদাতা কমিটি” গঠিত হয় এবং তাতে আমাদের পার্টির প্রতিনিধিরূপে আমি ছিলাম। সশস্ত্র সংগ্রামের অগ্রগতির পর্যায়ে আমাদের উভয় দলের কিছু দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল। আমরা মুক্ত এলাকা গড়ে তুলে সেখানে প্রগতিশীল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতি গ্রহণ ও কার্যকর করার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মডেল জনগণের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতাম এবং ঐ রকম রণকৌশল গ্রহণের কথা বলতাম। আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেবল সাধারণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতাম না। মেহনতী মানুষ শোষণ ও নির্যাতনমুক্ত সুখী জীবন গড়ার আকাঙ্খা থেকেই স্বাধীনতা চাইত। আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিক কৃষক মেহনতী মানুষের দৃঢ় ও শক্তিশালীরূপে সংগঠিত হয়ে ওঠার লক্ষ্য সামনে রেখেছিলাম। মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলে প্রগতিশীল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ কিছু নিতে পারলে সারা দেশের মেহনতী জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামে আরও উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়ে আসতো। আমরা জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজস্ব শক্তির ওপর নির্ভর করার ওপর জোর দিতাম। এই সকল বিষয়ে আওয়ামী লীগের স্পষ্ট ধারণা ছিল না।

 আওয়ামী লীগের একাংশের তরুণদের দ্বারা ‘মুজিব বাহিনী’ নামে একটি পৃথক বাহিনী হবার পর তাদের সঙ্গে এবং বিশেষ করে আমাদের সমর্থক গেরিলাদের দেশের ভেতরে প্রেরণের প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে আমাদের কিছু অসুবিধা দেখা দিত। এ সব সমস্যা সমাধানের জন্য পরে একটি কোঅর্ডিনেশন কমিটি গঠিত হয়েছিল।