পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২২০

 তবে সার্বিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কমিউনিস্টরা সব সময় তাদের আন্তর্জাতিক কর্তব্য হিসেবেই যে কোনো জাতির ন্যায্য সংগ্রাম-জাতীয় স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে সমর্থন করে। এই নীতি থেকে বস্তুত আমাদের প্রচেষ্টা ছাড়াই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের জাতীয় সংগ্রামকে সমর্থনে এগিয়ে আসে এবং বাংলাদেশের পক্ষে ভারতে জনমত গঠনে প্রভূত সহায়তা করে। এ জন্য তাঁরা নিজেরাই প্রচার গড়ে তোলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিশেষত পাক বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতন ও গণহত্যা এবং প্রায় এক কোটি ছিন্নমূল নরনারী ও শিশুর ভারতে আশ্রয় গ্রহণ ইত্যাদি ভারতের জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে গভীর আবেগ সৃষ্টি করেছিল। তারা, বিশেষত সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের শরণার্থী ও উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে যে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন তা হাসিমুখে সহ্য করেছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই জনমতকে আরও বিস্তৃত ও সংহত করার জন্য অবদান রেখেছে। ভারতের বিরোধী দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কিছু কিছু বিভ্রান্তি ও বিরুদ্ধ মত ছিল। কোনো কোনো প্রশ্নে কংগ্রেসেরও দোদুল্যমানতা ছিল। এক্ষেত্রে ভারতের অভ্যন্তরে একটি রাজনৈতিক লড়াই ছিল। এই লড়াইয়ে বাংলাদেশের পক্ষে সি পিআই-র সুস্পষ্ট ভূমিকা দ্বারা আমাদের সংগ্রাম লাভবান হয়েছে।

 আগেই বলেছি যে, ২৫শে মার্চের আগেই আমরা ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলোর কাছে আমাদের সম্ভাব্য স্বাধীনতা সংগ্রামের সহায়তার জন্য পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে চিঠি পাঠাই। এরপর ভারতে যাওয়ার পর মে মাসে আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সদস্য ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে এক বৈঠকে বসে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের কোচিনে অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে আমাদের পার্টির একটি প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়েছিল এবং সেখানে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিস্তৃত জানানোর সুযোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আগে থেকেই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিল।

 সকলেই জানেন যে রণক্ষেত্র থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের টেবিল পর্যন্ত সর্বত্র প্রতিবেশী ভারত ব্যতীত সোভিয়েত ইউনিয়সহ বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবির এবং আন্তর্জাতিক প্রগতি ও শান্তির শক্তিসমূহের সক্রিয় সমর্থন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। আমাদের পার্টি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও শান্তির শক্তিসমূহের সমর্থন ও সাহায্য সমাবেশ করার কাজে উদ্যোগ নিয়েছিল। আমাদের পার্টিই উদ্যোগী হয়ে এপ্রিল মাসে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রমেশ চন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর সহায়তায় তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বিদেশে পাঠায়। এই দলের সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের আবদুস সামাদ আজাদ, ন্যাপের দেওয়ান মাহবুব আলী (ফেরার পথে দিল্লীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন) এবং কমিউনিস্ট পার্টির ডা. সারোয়ার আলী। এই “শান্তি প্রতিনিধিদল” ইউরোপের বিভিন্ন রাজধানী সফর করে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের কাছে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনীর ভয়াবহ গণহত্যা এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয় তুলে ধরেন। এটাই ছিল বিদেশে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিনিধিদল। তখন পর্যন্ত কোলকাতা ছাড়া বিদেশে কোথাও বাংলাদেশ সরকারের মিশন সংগঠিত হয়নি।

 উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে বিদেশে এমনকি প্রগতিশীল মহলেও আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে নানারূপ প্রশ্ন বিদ্যামন ছিল। বিদেশে পাকিস্তানীদের মিথ্যা প্রচার খণ্ডন করার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রকৃত তাৎপর্য এবং আমাদের সংগ্রাম যে ‘‘বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা” নয় ও জনগণের ব্যাপক সমর্থনপুষ্ট জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের ন্যায্য সংগ্রাম, একথাও বিদেশে প্রচারের প্রয়োজন ছিল। অন্য দেশের মুসলমানদের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে “মুসলিম দেশ পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য অন্য দেশের ষড়যন্ত্র” বলেও একটা বিভ্রান্তি ছিল। আমরা চিঠিপত্র ও প্রচার পত্রের মাধ্যমে বিদেশে এইসব ভ্রান্তি মোচনের চেষ্টা করেছি। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হবার কিছুকাল আগে হতেই আমরা নিশ্চিত