পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২২৫

মোশাররফ হোসেন

 অসহযোগ আন্দোলনের শুরতেই আমি নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র ও এক্সপ্লোসিভ যোগাড় করতে থাকি। ২৪ শে মার্চ কর্ণফুলী নদীতে অবস্থানরত ‘সোয়াত’, জাহাজ হতে শেল নিক্ষেপ করা হয়। ক্যাণ্টনমেণ্ট হতে বাঙ্গালী সৈন্যের একটি দল ক্যাপ্টেন রফিকের অধীনে কুমিরার দিকে যাত্রা করে। ২৫শে মার্চ রাত্রিতে চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টে গোলাগুলি বিনিময় হয়।

 ইতিমধ্যে আমি ও আমার সংগীরা শুভপুর ব্রীজটির আংশিকভাবে ক্ষতিসাধন করি। অন্যদিকে চট্টগ্রামের দিকে আসার সময় লোকদিগকে রাস্তায় গাছপালা, ইটপাটকেল ইত্যাদি দিয়ে নানভাবে প্রতিরোধ সৃষ্টির জন্য পরামর্শ দেই। ২৬ তারিখে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসরমান পাক সেনাদের সঙ্গে কুমিরার ক্যাপ্টেন রফিকের দলের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঐ যুদ্ধে একজন ক্যাপ্টেনসহ অনেক পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায়। পরে মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে আর এক দল বাঙ্গালী সৈন্য কালুরঘাটের দিকে যাত্রা করে।

 এদিকে সমস্ত চট্টগ্রাম আমাদের অধীনে চলে আসে। হান্নান সাহেবসহ আমি অনতিবিলম্বে কালুরঘাটস্থ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত হই এবং আমরা স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করি। হান্নান সাহেবই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বক্তা এবং তিনি বেলা দেড় ঘটিকার সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

 ২৬ তারিখ রাত্রে ‘সোয়াত' জাহাজ হতে চট্টগ্রাম শহরে অবিরাম গুলিবর্ষণ হয়। আমরা চট্টগ্রাম শহরে ক্যাণ্টনমেণ্টের ঘেরাওকৃত বাঙ্গালী সৈন্যদের সাহায্য করার প্রচেষ্টা চালাই তখন সমস্ত যুদ্ধ ব্যবস্থা মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন চলতে থাকে। ২৯ শে মার্চ তিনি শেখ মুজিবর রহমানকে Head of the State’ এবং নিজেকে ‘Supreme Commander of the Bengali Armed forces' ঘোষণা করে যুদ্ধ পরিচালনা করতে লাগলেন। কিন্তু এপ্রিল মাসের তৃতীয় দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম শহরের কিছু কিছু অংশ ব্যতীত সবটুকুই পাক সেনাদের অধীনে চলে যায়। আমরা তখন কালুরঘাট ছেড়ে রামগড়ে চলে যাই। আমাদের অবস্থান আরও দৃঢ় করার জন্য এখানে একটি কণ্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। চট্টগ্রাম শহর দখল করেই পাক সেনারা চট্টগ্রামের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ৭ ই এপ্রিল কালুরঘাটের পতন হয়।

 ঢাকা-চট্টগ্রাম তখন ক্যাপ্টেন শমসের মবিনের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ চলছিল। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালী ও পাক সেনাদের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে। সীতাকুণ্ডে পাক-বাহিনীর সঙ্গে একটি যুদ্ধ হওয়ার পর ক্যাপ্টেন মবিনের সৈন্য বাহিনী চিনকি আস্তানায় চলে যায়। বাঙ্গালী সৈন্যবাহিনী এরপর মীরশ্বরাই ব্রীজের ক্ষতিসাধনের জন্য এখানে সমবেত হয়। এপ্রিলের প্রথম দিকে আমাদের সৈন্যবাহিনী এক সপ্তাহ যাবত পাক হানাদারদের মোকাবেলা করেছিল। ১৭ তারিখে ব্রীজ হতে দূরে বাঙালী ও পাক বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় দুটি কনভয়সহ প্রায় ৪০০ জন পাক সৈন্য ধ্বংস হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাঙ্গালী সৈন্যরা বেলা দুটোর মধ্যে পিছু হটতে বাধ্য হয়। একজন বাঙ্গালী সুবেদার মৃত্যুবরণ করেন এবং দুজন সেপাই আহত হন।

 ঐদিন রাত্রেই আমরা মীরেশ্বরাই থেকে সামান্য উত্তরে মোস্তাননগরে ওঁৎ পেতে থাকি। ১৮ তারিখে পাক সেনাদের সাথে একটি খণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে প্রায় ৩০/৪০ জনের মত পাক সৈন্য নিহত হয়। ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় ঐ স্থান ছেড়ে বাঙালী সৈন্যরা করেরহাট চলে আসে এবং হিংগুলি ব্রীজটির ক্ষতিসাধন করে। মোস্তান নগর যুদ্ধের পর পাক সেনার আর বেশী অগ্রসর হতে পারেনি। তারপর আমাদের সৈন্যরা রামগড় রাস্তার ওপর তুলাতুলি ব্রীজটি উড়িয়ে দেয়। এদিকে শুভপুর, তুলাতুলি, খাগড়াছড়ি ও ফটিকছড়ি প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধ চলছিল এবং ক্রমান্বয়ে পাক সেনারা রামগড় ঘিরে ফেলে। আমরা সীমান্ত পেরিয়ে সাবরুমে চলে যাই। পরে হরিনাতে গিয়ে একটি Army Camp ও পাশাপাশি ‘Youth Camp' গঠন করি। উক্ত ক্যাম্পে যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। প্রশিক্ষণ নেয়ার পর তারা বিভিন্ন গেরিলা দলে বিভক্ত