পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৩৩

পাকিস্তান আক্রমণ করেছে। ভারতীয় সেনা লাহোর শহরের উপকণ্ঠে শালিমার বাগান পর্যন্ত এসেছে এবং এর সঙ্গে অন্যান্য ফ্রণ্টেরও কিছু কিছু প্রাথমিক খবর। তিনি বললেন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ। কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন তারপরেই বলে উঠলেন ‘দেশটাকে বাঁচানো যায়। একটা বড় সুযোগ এসে গেছে। ‘আমরা যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেই’ বলে তিনি কিছুক্ষন থামলেন। যাহোক, তিনি খুবই উত্তেজিত অথচ পরিবেশটা এই আলোচনার উপযুক্ত নয়। হেনা ভাই (কামারুজ্জামান) আমার চোখের দিকে তাকালেন। ইতিমধ্যে শেখ সাহেব বাথরুমে গেছেন। তিনি বললেন যে, নেতা খুবই উত্তেজিত, কথাবার্তা অসংলগ্ন হচ্ছে। তাকে এখান থেকে সরাতে হবে। শেখ সাহেব ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে হেনা ভাই এবং আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে প্রায় এক রকম জোর করে নীচে নিয়ে এলাম। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। তার জীপে ৩২নং রোডের বাড়ীতে এসেই তাজউদ্দিন সাহেবকে ফোনে ডেকে পাঠালেন। তিনি এলেন। আমরা মোট চারজন। তাকে আমরা তিনজনই বুঝাতে চেষ্টা করলাম আপনার কথা আমরা বুঝতে পারছি কিন্তু এ রকম একটা কাজ করতে যাওয়ার আগে অনেকগুলো দিক খুবই গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করতে হবে তবে মনে হয় এখন তার উপযুক্ত সময় নয়। দেশবাসী এটার জন্য প্রস্তুত নয়। এটাই বঙ্গবন্ধুর নিকট প্রকাশ্য স্বাধীনতার কথা আমি প্রথম শুনতে পাই।

 ১৯৬৬ সাল।পাক-ভারত যুদ্ধের পরবর্তী অবস্থা। ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশের চলাচল বন্ধ। শ্রীলংকা ঘুরে বিমান ঢাকা-করাচী সংযোগ রক্ষা করছে। ২রা এপ্রিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আমরা মোট ৬ জন যাচ্ছি লাহোরে একটি জাতীয় সম্মেলনে যোগদান করতে। তাসখন্দ ঘোষণার পর পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতারা ডেকেছেন এই সম্মেলন। আলোচ্য বিষয়- তাসখন্দ ঘোষণা জাতীয় স্বার্থকে মারাত্মকভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের জোয়ানরা যুদ্ধক্ষেত্রে যে জয়লাভ করেছিল আইউব খা ঁআলোচনার টেবিলে তা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে দিয়ে দিয়েছেন। যাহোক আমরা শ্রীলংকা ঘুরে সকালের দিকে গিয়ে পৌ ঁছালাম করাচীতে। বিমান বন্দরে হাজার হাজার বাঙালী বঙ্গবন্ধু এবং তার দলকে অভ্যর্থনা জানালো। দলের মধ্যে (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, (২) তাজউদ্দিন আহমদ, (৩) আব্দুল মালেক উকিল, (৪) আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ নূরুল ইসলাম চৌধুরী, (৫) এবিএম নূরুল ইসলাম এমএনএ এবং (৬) আমি নিজে। সব বাঙালীর একটাই প্রশ্ন ‘মুজিব ভাই, আমাদের বাঙালীদের কি হবে”। তিনি সবাইকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে বললেন, “দেখ বাঙালী জাতির দাবিতো ন্যায্য দাবী। আমরা পথ খুঁজে পাবই।” আমরা গিয়ে উঠলাম মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা আখতার সোলায়মান বেবীর বাসা বিখ্যাত “লাখাম হাউসে”। সেখোনেও সারাদিন বহু লোকের আনাগোনা-বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে। সবারই একই প্রশ্ন এই সংকট উত্তরণের পথ কি? এর মধ্যে দুপুরের আহারের পর শেখ সাহেব আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে বসলেন এবং বললেন আমাদের নিজেদের মধ্যে কিছুজরুরী আলোচনা আছে। তারপর তিনি সঙ্গে নিয়ে আসা ৬ দফার’ কাগজপত্র ব্যাগ থেকে বের করলেন। আমরা পড়লাম। তিনি আমাদের বিশদ বুঝানোর চেষ্টা করলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর আমি বললাম, “আপনি আমাদের নেতা, বহু দিক বিবেচনা করার পর আপনি এই ৬ দফা প্রনয়ণ করেছেন এবং দেশবাসীর সামনে তা দিতে যাচ্ছেন। মনে হয়, পশ্চিম পাকিস্তান, বিশেষ করে পাঞ্জাব এই ৬ দফা মানবে না।” আমি এর কারণ বিশ্লেষণ করে বলবার চেষ্টা করলাম, “এই ৬ দফা যদি অমননীয় হয় তাহলে এটা সরাসরি ১ দফার দিকেই চলে যাবে। আমরা কি এর জন্য তৈরী হয়েছি?” প্রায় সবাই একই মত প্রকাশ করলাম। তাজউদ্দিন ভাই মুচকি মুচকি হাসছিলেন। জানি না নেতার সঙ্গে তার পূর্বে এ সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে কি-না। বঙ্গবন্ধু অনেক দিক দিয়ে বিষয়টির উপর আলোকপাত করে বললেন“আজ হোক কাল হোক পূর্ব পাকিস্তান কে একদিন আলাদা হতেই হবে। এ রকম কৃত্রিম ভৌগোলিক অবস্থান,আর্থসামাজিকও সাংস্কৃতিক ভিন্ন অবস্থা নিয়ে দুটা অংশ কতকাল দাড়িয়ে থাকবে। এটা সত্য কথা যে, আমরা দেশবাসীকে এখনও তৈরী করার কাজে হাত দেইনি। তবে বাঙ্গালীরা অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন। সংগঠনের মাধ্যমে এটা করা যাবে। “এরপর লাহোরের সম্মেলন সম্পর্কে আলোচনা হল এবং আমরা কোন লাইন গ্রহণ করবো তাও তিনি জানিয়ে দিলেন। এর পরের