পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৩৪

কথা- পরদিন আমরা লাহোরে গেলাম সরাসরি সম্মেলন স্থানে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনের সামনের বিরাট লনে এই সম্মেলনের আয়োজন। নেতাকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থণা করা হল। আমরা বসলাম। সম্মেলন তখনো শুরু হয়নি। সময় সকাল ৯-৩০মিঃ। সাবজেক্ট কমিটির সভা শুরু হবে। বঙ্গবন্ধু মালেক ভাইকে পাঠালেন সাবজেক্ট কমিটির সভায়। তিনি সেখানে বক্তব্য রাখলেন- এটা যেহেতু জাতীয় সম্মেলন, সেহেতু জাতীয় সমস্যাগুলি আলোচনার মাধ্যমেই এখানে প্রতিফলিত হবে। তাসখন্দ ঘোষণা ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বন্যা, অর্থনৈতিক শোষণ, চাকুরীর ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য, মারাত্মক বেকার সমস্যা এগুলিও আমাদের জাতীয় সমস্যা এবং এগুলিও এই সম্মেলনে আলোচিত হবে। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, সিন্ধু এবং সীমান্ত প্রবেশেরও অনেক সমস্যা আছে- সেগুলিই বা কেন এখানে আলোচনা করা যাবে না। কিন্তু চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর যুক্তি হল- এতগুলো সমস্যা আলোচনা করতে গেলে মূল আলোচ্য বিষয় (তাসখন্দ ঘোষণা) গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কোন সমস্যারই আলোচনা হবে না এই কথার পর আওয়ামী লীগের অনমনীয় মনোভাবের ফলে সাবজেক্ট কমিটিতে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগের পক্ষে ওয়াক আউট করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। সম্মেলন ত্যাগের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফার কাগজপত্র আমাদের হাতে দিলেন বিলি করার জন্য। বিখ্যাত ৬ দফা এইভাবেই লাহোরে প্রথম জনগণের হাতে গিয়ে পৌঁছুল। সম্মেলন স্থানের অনতিদূরে মালিক গোলাম জীলানী সাহেবের বাসায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমার সম্মেলন থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রায় ৩/৪ শত পশ্চিম পাকিস্তানী, অবশ্য অধিকাংশই আমাদের আওয়ামী লীগ কর্মী, আমাদের ধাওয়া করে। আমরা দ্রুত হেঁটে জিলানী সাহেবের বাসায় পৌঁছলাম। মালিক জিলানী এবং আজম খান এই দুইজন শেখ সাহেবের দুই পার্শ্বে দেহরক্ষীর কাজ করেছিলেন। জিলানী সাহেবের বাসায় পৌঁছার পর আর এক দৃশ্য। আসলে আমরা সকাল থেকে কেউই চা নাস্তা করিনি। অনেক সকালে উঠে করাচী বিমান বন্দরে ছুটতে হয়েছিল লাহোরগামী বিমান ধরার জন্য। আমরা পাশের ঘরে চা খাচ্ছি তখন ভীষণ গোলমালের শব্দ কানে কানে আসে। ব্যাপার কি? জিলানী সাহেব এসে বললেন ৩/৪ শত লোক এসেছে বঙ্গবন্ধুর কাছে। তাদের প্রশ্ন আপনি এত বড় একটা সম্মেলন কেন বানচাল করে দিলেন এবং এর দ্বারা আপনি বিরোধী দলগুলির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সম্মেলন কেন নষ্ট করে পরোক্ষভাবে আইউব খানকেই সাহায্য করলেন। তারা খুবই উত্তেজিত, বিক্ষুব্ধ এবং বিশৃঙ্খল। পরে অবশ্য তিনি সবারই বক্তব্য শোনার পর তার বক্তব্য দিলেন। ১ঘণ্টাব্যাপী এই বক্তব্যে পূর্ব পাকিস্তানের এবং তারপর সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশের নিপীড়িত বঞ্চিত দরিদ্র জনগণের যে করুণ এবং মর্মান্তিক কাহিনী ব্যক্ত করলেন তা শুনে অনেকেই কেঁদে ফেললেন। বিশেষ করে বেলুচিস্তান এবং সীমান্তের কিছু নেতা বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। তুমি শুধু পূর্ব পাকিস্তানের নেতা নও- আমাদেরও নেতা। আমাদের কথা কেউই তো সাহসের সাথে এমন করে কোনদিন বলেনি। তারপরও তিনি ৬ দফার ওপর সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন। অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের কাগজগুলিতে ৬ দফা নিয়ে ঝড় উঠতে শুরু করল।

 ১৯৬৬ সালের জাতীয় পরিষদের শীতকালীন অধিবেশন বসেছে ঢাকায়। আমার একটা প্রস্তাব (Resolution) গৃহীত হল আলোচনার জন্য। বিষয়বস্তু ছিল 'পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আমদানী নীতি (Separate Import policy for East Pakistan)। আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যের ওপর তুলনামূলক আলোচনা করে দেখানোর চেষ্টা করলাম যে, দুই অঞ্চলের অবস্থা, বিশেষ করে শিল্প- বাণিজ্যের অবস্থা এবং সমস্যা পৃথক বলেই একই নীতিতে দুই অঞ্চলের সমস্যার সমাধান হবে না। বললাম, দুই পৃথক রোগীর জন্য একই প্রেসক্রিপশন চরতে পারে না। এর ওপর আলোচনার ঝড় উঠলো। আর তার চেয়েও বেশি ঝড় সৃষ্টি হল পশ্চিম পাকিস্তানের চলতে পারে না। এর ওপর আলোচনার ঝড় উঠলো। আর তার চেয়েও বেশি ঝড় সৃষ্টি হল পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলিতে। Pakistan times তো সম্পাদকীয়তে বলেই ফেললো, অধ্যাপক ইউসুফ আলী আওয়ামী লীগের লোক- আওয়ামী লীগ ৬ দফার মাধ্যমে দেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায় এবং এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমি এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। প্রস্তাবটি ভোটে হেরে গেলেও আমরা পূর্ব পাকিস্তানের করুণ অবস্থা তুলে ধরবার চেষ্টায় মোটামুটি সফল হয়েছি। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা গাউস