পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৩৬

 দিনাজপুরে ফিরেই টেলিফোনে শেখ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাঁকে ব্যাপারটা জানাতে তিনি বললেন ওরা ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করছে আলোচনা পণ্ড করার জন্যে। যা হোক তোমরা চেষ্টা করো যাতে সৈয়দপুরের অবস্থা দিনাজপুরে সংক্রমিত না হয়। আমি প্রতিদিনই ঢাকায় তাঁর সাথে যোগাযোগ করে জানবার চেষ্টা করতাম আলোচনার অগ্রগতি এবং ঢাকার অবস্থা। সেদিন জানতে চাইলে তাঁর মনের হতাশা কিছুতেই চাপা থাকল না।

 ২৪ এবং ২৫ শে মার্চে সারাদিন আমরা কয়েকজনে মিলে দিনাজপুর শহরের বিহারী এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে তাদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম যেন বাঙ্গালী-বিহারী সম্প্রীতি কিছুতেই ক্ষুণ্ন না হয়। ২৫ শে মার্চ বিকেলে ই,পি,আর সেক্টর কমাণ্ডার তারেক রসুল কোরেশীর সাথে ফোনে আলাপ করলাম। তিনি বললেনআমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি অবস্থা শান্ত এবং নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।

 ২৫শে মার্চ সন্ধ্যার পর আমি বাসা থেকে বেরোচ্ছি আওয়ামী লীগ অফিসে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ বাইরের ঘরে ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরতেই বঙ্গবন্ধুর সেই ভারী গলা- তিনি দিনাজপুরের অবস্থা জানতে চাইলে সংক্ষেপে জানিয়ে বললাম ঢাকার কি অবস্থা। তিনি বললেন, মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করো। আরেকবার ঢাকার কথা জানতে চাইলে তিনি আবার বললেন ‘সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাবে’ বলেই ফোন ছেড়ে দিলেন। অন্যান্য দিন অন্ততঃ দু'এক কথায় ঢাকার অবস্থা তিনি জানাতেন কিন্তু আজ কেন কিছুই বললেন না ভেবে মনটা আশঙ্কায় দুলে উঠলো। এরপর আওয়ামী লীগ অফিসে কয়েকজন বসে আছি। অনিশ্চিত ও থমথমে অবস্থা। একটু আগেই নিউ টাউন থেকে ফিরেছি। সেখানকার অবাঙালী নেতাদের খুব উদ্ধত মনে হলো অথচ ইতিপূর্বে কতই না বিনয়ের সাথে আমার সঙ্গে বরাবর ভাল ব্যবহার করেছে। যা হোক রাত তখন ঠিক ১২টা ৩ মিনিট। হঠাৎ গুলির শব্দ। কখনও মনে হয় নিউ টাউন জিলা স্কুলের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গুলির শব্দ আরো প্রবল হল। আওয়ামী লীগ অফিসে থাকাটা আমরা নিরাপদ মনে করলাম না। সবাই আপন আপন বাড়ির দিকে দ্রুত রওয়ানা হলাম। বাসায় এসে মোটরসাইকেলটা রেখে টেলিফোনের কাছে এলাম। ভাবলাম এসপি’র কাছ থেকে জানবার চেষ্টা করি প্রকৃত ব্যাপারটা কি, ফোন তুলেই দেখি লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। হতভম্ব হয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে থানার দিকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। অতিরিক্ত এসপিকে পেলাম তিনিও বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। শুধু এটুকু বললেন মিলিটারীরা ট্রাকে করে বেরিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে বেড়াচ্ছে। এমনকি জিলা স্কুলের কাছে রাত্রিকালীন পাহারারত পুলিশের গাড়ীর দিকেও লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি? আরো ধাঁধায় পড়ে গেলাম।

 বড় অস্বস্তির মধ্যে ঘুমহীন রাত কেটে গেলো। ভোর রাতে আজানের পরপরই মাইকে প্রচার শুনলাম বেলা ১১ টা থেকে কারফিউ। দিনটি ছিল শুক্রবার।

 সকাল সাড়ে সাতটার সময় বারান্দায় বসে আছি। এমন সময় ডিসি’র একজন পিয়ন সালাম জানিয়ে আমার হাতে একটা স্লিপ দিল। তাতে ডিসি (ফয়েজউদ্দিন সাহেব) লিখেছেন আমার বাসায় আমার সঙ্গে চা খেলে আমি খুব খুশী হব। আমি ৮ টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। ইতিপূর্বে ভোর বেলায় আমার মা বলেন যে, তিনি রাতে খুবই খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন। রাস্তায় রাস্তায় কুকুর মানুষের লাশ ছিড়ে খাচ্ছে সুতরাং সবাইকে নিয়ে তখুনি গ্রামের বাড়ি চলে যেত চান। কিন্তু এই অবস্থায় আমি কি করে যাই! তাই আমি, আমার স্ত্রী ও কনিষ্ঠা মেয়েটি বাদে বাসার সকলেই গ্রামের বাড়িতে চলে গেল। বাসা থেকে বেরিয়ে থানার কাছে গিয়ে ওসিকে বললাম ডিসি’র বাংলোয় যেতে হবে কিন্তু যানবাহন তো নেই। এমনিতেই শুক্রবার দোকান-পাট বন্ধের দিন, তার ওপর কারফিউ ঘোষণা। এমন সময় অতিরিক্ত এসপি গাড়ী নিয়ে থানায় ঢুকলেন। তিনি বললেন, আমার মনটা কিন্তু সায় দিচ্ছে না যে আপনি ডিসি’র বাংলোয় যান। কারণ, পাশেই সার্কিট হাউস। মিলিটারীদের অস্থায়ী হেড অফিস। দেখাই যাক না কি হয় এই মনে করে তাঁর