পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৩৯

কয়েক শত গজ দূরে অবস্থান গ্রহনকারী মিলিটারীদের কাছে খবর পৌঁছে যেত। ইপিআর-দের টারগেট ছিল সার্কিট হাউসের পাশের ময়দান এবং বড় ময়দানের মাঝখানে অবস্থিত অফিসারস ক্লাব। এগুলিতেই মিলিটারীরা অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু বিপদ হল, সেখান থেকে গুলি কুঠিবাড়িতে আসছিল আরো দুটি স্থান থেকে। উপরোক্ত স্থান ছাড়াও রাজবাড়ীর কাঁটাপাড়া এবং সুইহারী ডিগ্রী কলেজের ছাদের ওপরেও যে মিলিটারীরা পজিশন নিয়েছিল সেটা ইইআর'রা জানতে পারেনি। তিন দিকের গুলির আক্রমণে তারা অনেকটা হতভম্ব হয়ে গেল।তখন তারা নতুন একটা কৌশল গ্রহণ কনল। কুঠিবাড়ির পশ্চিম পাশের প্রাচীর ভেঙ্গে তারানদীর বালুর ওপর অবস্থান নিয়ে সেখান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করল। এটা মিলিটারীরা টের পেলনা। এ সময়ে কাঞ্চন ঘাট, বাইশাপাড়া, কাঞ্চন রেলওয়ে ব্রীজের পশ্চিম পার্শ্বে উঁচু লাইনের দু'পার্শ্বের নীচু জায়গায় হাজার হাজার উল্লসিত মানুষের ঢল। তাদের মাথার ওপর দিয়ে গোলাগুলি ছুটছে অথচ তার মধ্যেই নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে নদী পার হয়ে ছুটে যাচ্ছে কুঠিবাড়ির ভেতর। সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাগুলির ভারী বাক্সগুলি কয়েকজনে মিলে অনায়াসে নদী পার করে পশ্চিম পাড়ে এনে জমা করছে। সেখানে গোলাগুলিতে ক’জন লোক নিহত হয়। এ যেন জীবনকে বাজী রেখে মহোল্লাসে মেতে ওঠার তীব্র প্রতিযোগিতা।সেখান থেকে রাতের মধ্যে খোশালডাঙ্গা হাটে সব অস্ত্রশস্ত্র ও মালপত্র এনে জড়ো করা হলো।

 এর মধ্যেও শহরের কয়েকটি লক্ষ্যে বিশেষ করে উপশহরে (নিউ টাউনে) গোলা নিক্ষেপ চলতেই থাকে। কারণ, মিলিটারী ও অবাঙালি ইপিআর'রা পিছিয়ে এখানেই আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। সারা রাতব্যাপী গোলাগুলি চলে।

 পরের দিনই দুটো ঘটনা ঘটল। দিনাজপুর শহরের অমিয় কুটিয়ে সিকিউরিটিসহ মেজর রাজা থাকতো সপরিবারে। তার স্ত্রী কুষ্টিয়ার রাজনৈতিক নেতা জনাব সাদ আহমদ সাহেবের বোন। মেজর রাজা যখন অয়ারলেস সেটের সামনে বসে করাচী এবং অন্যান্য স্থানে খবর পাঠানোর চেষ্টা করছিল, ঠিক সেই সময়ে ইপিআর'রা তাকে ধরে নিয়ে আসে এবং দিনাজপুর হেমায়েত আলী হলের সামনে গুলি করে হত্যা

 মেজর তারিক আমিন সকাল বেলা ডিসি'র বাংলোয় এসে তার কাছে দেখা করে প্রাণ ভিক্ষা চায় এবং আশ্রয় চায়। অবশ্য ডিসি’র পক্ষে সেই পরিস্থিতিতে তা করা সম্ভব ছিল না। তার একদিন পরেই শহরের উপকণ্ঠে কসবা এলাকায় নদীর তীরে তাকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয়। লেঃ কর্নেল তারেক রসুল কোরেশী জনৈক স্থানীয় চেয়ারম্যান (পরবর্তীতে রাজাকার হিসেবে তাকে কারাগারে দীর্ঘ দিন থাকতে হয়েছিল)- এর সহায়তায় মোহনপুর ব্রীজ পার হয়ে আমবাড়ী দিয়ে রাতের অন্ধকারে পরবর্তীপুর পৌঁছে প্রাণ বাঁচাতে সমর্থ হয়েছিল। তারপর কয়েকদিনের জন্য কাঞ্চন ঘাট থেকে ২ মাইল পশ্চিমে ভবানীপুরে আফতাবউদ্দিন সরকার সাহেবের বাড়িতে সাময়িকভাবে জেলা সদর স্থানান্তরিত হয় এবং জেলা কর্মকর্তাগণ সেখান থেকেই সেই অস্বাভাবিক অবস্থায় যতটা সরকারী কাজকর্ম, নির্দেশনামা জারী করতে থাকেন।

 ৩১ তারিখে দিনাজপুর ইনিস্টিটিউট প্রাঙ্গণে সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (ক) অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী, (খ) গোলাম রহমান, (গ)এ,এম আই জেড ইউসুফ এবং (ঘ) গুরুদাস তালুকদার- এই ক’জনের নামে একটি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করতে হবে। প্রচারপত্রে অবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের দাবি করা হবে এবং জনগণকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানানো হবে। এই প্রচারপত্র ১লা এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত হয় এবং এই সপ্তাহেই কোলকাতা থেকে প্রকাশিত থেকে দৈনিক ‘কালান্তর' পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়।

 এই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে অবিলম্বে কয়েকটি কাজ করতে হবে। সেগুলি হচ্ছে ভারতে গিয়ে ভারত সরকার এবং আন্তর্জতিক বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে বাংলাদেশের অবস্থানকে তুলে ধরা; বাংলাদেশের অন্যান্য নেতার সঙ্গে সম্ভব হলে যোগাযোগ স্থাপন করা; এবং আমাদের ইপিআর,