পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৪০

পুলিশ, আনসারসহ যুদ্ধরত জনগনের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করা। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে আমি ২ রা এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করি। এর পূর্বে দিনাজপুরের ডেপুটি কমিশনার আমার কাছে কিছু নির্দেশ চাইলে আমি তাকে নিম্নলিখিত নির্দেশাবলী দেইঃ কোন অবস্থাতেই কোন ব্যাংকের স্ট্রং রুম থেকে যাতে নগদ অর্থ এবং সোনা রুপা গয়না লুটতরাজ না হয়; প্রয়োজন না হলে কোন ব্যক্তিকে হত্যা না করা;দেশের ভেতরে সীমান্তের কাছাকাছি খাদ্যশস্য মওজুদ করা যাতে যুদ্ধরত লোকদের খোরাকীর কোন অসুবিধা না হয়।অতঃপর ভারতের উদ্দেশে আমি রওয়ানা হই।

 সীমান্তের ওপারেই অবস্থিত রাধিকাপুর স্টেশনে আমাকে অভ্যর্থনা জানান পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়ঞ্জ মহকুমার পুলিশ অফিসার। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল জেলাসদর বালুর ঘাটে। সেখানে এসপি’র অফিসে দীর্ঘক্ষণ সার্বিক পরিস্থিতি, মুক্তিযুদ্ধ ও জনগণের সংগে পাক সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের কৌশলগত দিক এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলে। অতঃপর এসপি মিঃ হ্যারিস জেমস পশ্চিম বংগের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় মুখার্জী মহাশয়ের একটি বার্তা আমাকে দেন। ঐ বার্তায় মুখ্যমন্ত্রী আমাকে অবিলম্বে কোলকাতায় পৌঁছে তার সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমি পরদিন স্থানীয় কংগ্রেস এমএলএ- এর সঙ্গে কোলকাতায় পৌছে সরাসরি কংগ্রেস অফিসে যাই। সেখানে আমাকে অভ্যর্থনা জানান শ্রী অরুণ মৈত্র (পরবর্তীতে পশ্চিম বাংলা কংগ্রেস প্রেসিডেণ্ট)। অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচয় এবং কিছু আলাপ আলোচনার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ৩৪ ইণ্ডিয়ান মিরর স্ট্রিটে “বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির” অফিস কক্ষে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় মুখার্জী পূর্ব থেকেই উপস্থিত ছিলেন। উষ্ণ আন্তরিকতা নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। তারা তাদের প্রধান সমস্যার কথা বললেন- বাংলাদেশের কোন সংবাদই তারা ভালভঅবে পাচ্ছেন না। বিক্ষিপ্তভাবে প্রাপ্ত কিছু সংবাদের ওপর ভিত্তি করে তারা পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারছেন না। সেই অবস্থায় এই অসুবিধা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, আমাদের পক্ষেও পুরোপুরি বলা সম্ভব ছিল না বাংলাদেশের কোথায় কী ঘটছে। সবরকমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বিশেষ করে সেই দিনগুলিতে আমি ছিলাম দেশের দূরতম এক সীমান্ত জেলা দিনাজপুরে। আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার দেয়া সংবাদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই আমদের জানাবার ছিল না। তবু এর মধ্যে এই সহায়ক সমিতি একটি অফিস করেছেন এবং কিছু চাঁদা আদায় করে বালুঘাট বেনাপোল সীমান্ত বরাবর উদ্বাস্তু এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সাহায্য পৌঁছাচ্ছেন। এই সহায়ক সমিতি সর্বদলীয়ভাবে গঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে এটি গঠিত হয়েছিল এবং ১৯৭১- এর শেষ পর্যন্ত এই সমিতি আমাদের প্রচুর সাহায্য সহযোগিতা দান করেছিল। প্রথম দিনই অর্থাৎ ৪ঠা এপ্রিল তারিখে মুখ্যমন্ত্রী আমার কাছে তার অসন্তোষ প্রকাশ করলেন এই বলে যে, দু'তিন দিন আগে বাংলাদেশের দুইজন নেতা তার সংগে দেখা কর দিল্লী চলে গেছেন। তারা তাদের আসল পরিচয় না দিয়ে দুটি ছদ্মনাম মাহমুদ আলী ও রহমত আলী বলে চলে গেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ধারণা উপরোক্ত দু'জন নেতা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রকৃত সংবাদ গোপন করেছেন। পরে জানতে পারি তাঁরা ছিলেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। শ্রী অজয় বাবু ছাড়াও এই সমিতিতে ছিলেন প্রাদেশিক মন্ত্রী সন্তোষ রায়, ডাঃ জয়নাল আবেদীন, শ্রী কাশীকান্ত মৈত্র, কংগ্রেসের অরুণ মৈত্র, গোপালপুর কমিউনিস্ট পার্টির স্বাধীন গৃহ এবং শ্রী বিজয় সিংহ নাহার প্রমূখ নেতৃবৃন্দ।

 আমার থাকবার জায়গা তাঁরা করে দিলেন কীড় স্ট্রীটের এমএলএ ভবনে। তারপর চেষ্টা চলল নেতৃবৃন্দের সাথে সংযোগ স্থাপনের। প্রথম দেখা হল জনাব কামারুজ্জামান সাহেবের সাথে বালিগঞ্জ এলাকার রাজেন্দ্র রোডের নর্দার্ন পার্কের একটি বাড়িতে। পরর্তীতে জানা গেল বাংলাদেশ থেকে আগত উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের জন্য এই বাসাটি সংরক্ষিত ছিল। বাসাটির তিন তলায় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বেতার যন্ত্র ছাড়া যোগাযোগ স্থাপনের অন্যান্য উপকরণ দ্বারাও এটি সজ্জিত ছিল। এর পরে তাজউদ্দিন সাহেব ফিরে এলন দিল্লী থেকে।পরপরই এলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং খোন্দকার মোশতাক আহমদ সাহেব। প্রথম দিকে নেতৃবৃন্দের জন্য বাসস্থান নির্দিষ্ট ছিল ১০, লর্ড সিনহা রোডে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের