পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৪৪

ইত্যাদি এবং কিছু নগদ টাকা প্রত্যেককে দেয়ার সিদ্ধান্তও গৃহীত হল। এক কোটি বাংলাদেশের শরণার্থীকে সসম্মানে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য বহু টাকা ব্যয় এবং এত বড় আয়োজনের ব্যবস্থা এটা একটা সহজ কাজ ছিল না। মিসেস গান্ধীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল। আর একবার সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অফিসে ফিরে এলাম।

 ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দ এবং বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন বাংলাদেশের মাটির অভূতপূর্ব অনুভূতি তখনো সদ্য সজীব। এ অবস্থায় একটা প্রলয়ঙ্কারী ও মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে যা দিনাজপুরবাসী কোন দিন বিস্মৃত হবে না। দিনাজপুরের মহারাজাদের তৈরি স্কুল। নাম মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল। বিস্তীর্ণ এলাকা। সামনে বিরাট খেলার মাঠ। বিরাট স্কুল গৃহ, মজবুত এবং দেখবার মত। ১৯৪২ সালে অবিভক্ত ভারতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কোলকাতা রিপন কলেজের একটি শাখা দিনাজপুরে খোলা হয় এবং এই মহারাজা স্কুলেই সকালের শিফটে সেই কলেজ চলতো। পাক-বাহিনীর আত্মসমপর্ণের পর ৭নং সেক্টরের সব মুক্তিযোদ্ধা দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করলে তাদের জন্য কয়েকটি শিবিরের ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে দিনাজপুর স্টেডিয়াম ও মহারাজা স্কুল গৃহ- এই দু'টিই ছিল বড় শিবির। মহারাজা স্কুলের সামনের মাঠে আণ্ডার গ্রাউণ্ড ঘর তৈরি করে উদ্ধারকৃত সমস্ত অস্ত্র রাখার ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় প্রতিদিন ট্রাকে করে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে এসে এখানেই জমা করা হতো। সেদিন ৬ই জানুয়ারী। হিলি সীমান্ত থেকে দুই ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র (বিভিন্ন প্রকারের তাজা বোমাসহ) নিয়ে এসে সেগুলো ট্রাক থেকে নামিয়ে মাটির নিচের ঘরে রাখার কাজ শুরু হয়। সময় সন্ধ্যা ৬-৩০ মিঃ। হয়ত অন্যমনস্কতার কারণে তাজা বোমা কারো হাত থেকে পড়ে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। এই বিস্ফোরণ এত প্রচণ্ড এবং ভয়াবহ হয় যে সম্পূর্ণ স্কুলগৃহ ধ্বংস হয়ে যায়। স্কুলগৃহের সামনের মাঠটি একটি বিরাট পুকুরে পরিণত হয়। শুধু দিনাজপুর নয় এই শহর থেকে ১৯ মাইল দূরে পাবর্তীপুর শহরেরও কিছু বাড়ীঘরের জানালার কাচ ভেঙ্গে যায়। ৪৫০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা সেখানে থাকতেন। দুর্ঘটনার পর আহতদের আর্তনাদে এক করুণ এবং মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডাক্তারদের কাছে পাঠানো ও নিহতদের লাশ উদ্ধার কার্যে শহরের হাজার হাজার মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তবে পুরো মৃতদেহ পাওয়া যায়নি বলা চলে। প্রায় সকলেরই দেহ ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। লাশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এক জায়গায় জমা করে মোটামুটি হিসাবে ১৬০ জনের মত নিহত মুক্তিযোদ্ধার লাশ সংগ্রহ করে শহরের তিন মাইল উত্তরে সুবিখ্যাত চেহেল গাজী মাজারের একপাশে দাফন করা হয়। ঘটনার ৬/৭ মাস পরে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করার সময় আরো প্রায় ৪০ টি মাথার খুলি পাওয়া যায়। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের যারা বীরের মত জয়লাভ করে স্বাধীনতার রক্তসূর্যকে ছিনিয়ে আনলো তাদেরকে সামান্য একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এরূপ মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হল! বীরদের এই সকরুণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক সকরুণ মর্মন্তুদ অধ্যায় সৃষ্টি করে রাখবে।

মোহাম্মদ ইউসুফ আলী
নভেম্বর, ১৯৮৪


মোহাম্মদ বয়তুল্লাহ

 নওগাঁ ৭ উইং ই,পি, আর হেডকোয়ার্টারে ২৫শে মার্চের পূর্ব হতে ক্যাপ্টেন ও মেজর পর্যায়ের পাঞ্জাবী অফিসারবৃন্দের উপস্থিতির কারণে সংগ্রামের শুরুতে কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মার্চের শেষ ভাগে মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন বদলী হয়ে নওগাঁ আসেন এবং তাঁরা উভয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। তাঁরা প্রথমেই উপরোক্ত পাঞ্জাবী মেজর, ক্যাপ্টেন ও তৎকালীন নওগাঁর পাঞ্জাবী এস,ডি,ও-কে গ্রেফতার করেন। এ সময় আমি নওগা ঁসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলাম। আমার সক্রিয় সহযোগিতায় কয়েকদিনের মধ্যেই নওগাঁর বিভিন্ন ই,পি,আর ক্যাম্পের পাঞ্জাবী ও পাঠান সিপাহীদের গ্রেফতার