পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৪৭

কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এই সংঘবদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াসহ যাতীয় আর্থিক দায়িত্ব আমি স্থানীয় কর্মী ও নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় পালন করেছি। অতঃপর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র যোগান দেয়াই ছিল বড় সমস্যা। ২৯শে মার্চ আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের আসাম ও পশ্চিম বঙ্গ সীমান্তে সোনাহাট এবং সাহেবগঞ্জ সীমান্ত ঘাঁটির সেনাধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমাদের অনুরোধে উক্ত সেনাধ্যক্ষ প্রাথমিক বেসরকারী সাহায্য হিসেবে ১লা এপ্রিল মধ্যরাতে ২টি হাল্কা মেশিনগান, কিছুসংখ্যক রাইফেল এবং প্রচুর হাতবোমা প্রদান করেন। এসব অস্ত্র ও তিস্তা প্রতিরোধ কেন্দ্রে প্রতিরোধ কেন্দ্রে সরাসরি পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে আমি সোনাহাট এবং সাহেবগঞ্জের ভারতীয় সীমান্ত ঘাঁটি থেকে সামরিক সাহায্য নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠিয়েছি।

 ৫ই এপ্রিল ভূরুঙ্গামারী কলেজে আমরা প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলি। যুবক এবং ছাত্ররা এখানে প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। শীঘ্রই বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল থেকে বহু ছাত্র-যুবক এখানে আসতে থাকলে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি সম্প্রসারণ করা হয়। সমগ্র রংপুর জেলার বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে বাঙ্গালী ইপিআরবৃন্দকে আমরা ভূরঙ্গামারী থানায় সংঘবদ্ধ করতে সমর্থ হই। বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে আগত ইপিআরদের দুই কোম্পানী ইপিআরকে তিস্তা প্রতিরোধ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেই। এক কোম্পানী ইপিআরকে ভূরঙ্গামারীতে সংরক্ষিত রাখা হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ও প্রধান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসেবে ভূরুঙ্গামারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হানাদার কবলিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অসংখ্য গেরিলা যোদ্ধা তৈরি করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাথমিক ট্রেনিং দিয়েই গেরিলাদেরকে সরাসরি প্রতিরোধ ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তীকালে এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছে। সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে অত্র থানার বিভিন্ন ইউনিয়নের জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আর্থিক সাহায্য করেছেন। এছাড়া ভারতীয় জনগণ ভুরঙ্গামারী থানার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে চাল, গম, আলু, কেরোসিন, পেট্রোল, সিগারেট, বিস্কুট, ঔষধপত্র প্রভৃতি সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেছেন।

 ৮ ই এপ্রিল ভারতে আশ্রিত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এক জরুরী গোপন নির্দেশ আমি পাই। উক্ত নির্দেশে উত্তরাঞ্চলের সাবেক গণপরিষদ সদস্যবৃন্দকে অবিলম্বে ভারতের এক অজ্ঞাত স্থানে সম্মিলিত হয়ে স্থানীয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়। সে মোতাবেক ৯ই এপ্রিল আমি অত্র অঞ্চলের অপরাপর গণপরিষদ সদস্যদের নিয়ে ভারতের আসাম প্রদেশের গোয়ালপাড়া জেলার সোনাহাট সীমান্ত ঘাঁটিতে উপস্থিত হই। অতঃপর সামরিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে আমাদেরকে আসাম প্রদেশের গোয়ালপাড়া জেলার রূপসা বিমান বন্দরে নিয়ে আসা হয়। এখানেই আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বহু নেতার সাথে আমরা প্রথম মিলিত হই। কিছুক্ষণের মধ্যে তাজউদ্দিন আহমদ, কুষ্টিয়ার ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, শেখ ফজলুল হক মনি, ভারতের ইস্টার্ণ কমাণ্ডের প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা, আসাম ৮২তম সীমান্তরক্ষী ব্যাটালিয়নের সেনাধ্যক্ষ, কর্নেল আর দাস, রূপসা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন এবং আমাদের সঙ্গে জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে উত্তরাঞ্চলের ভারতীয় সামরিক সাহায্য, মুক্তিবাহিনীর তত্ত্বাবধান ও তাদের সার্বিক দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করা হয়। এই সময় জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, জনাব মতিউর রহমানসহ সাবেক বাংলাদেশ বাহিনী প্রধান ওসমানী মুক্তাঞ্চল সফর করে আমাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। এভাবে ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় জনগণের সাহায্য সহযোগিতা এবং ভারতীয় জনগণ ও সামরিক কর্তৃপক্ষের সাহায্যে আমরা ২৬শে যে পর্যন্ত কুড়িগ্রাম শহরের উত্তরে ধরলা নদীর উত্তর তীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অটল রাখতে সক্ষম হই। ২৬শে মে রাতে পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে আমাদের পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটি ভেঙ্গে গেলে আমরা ভারতে আশ্রয় গ্রহন করি।

 ভারতে প্রবেশের পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ করা হয়। ভারতের পশ্চিম বাংলা সীমান্তের সাহেবগঞ্জ ও আসামের সোনাহাটে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অনুমোদনে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা অধিকৃত ভূরুঙ্গামারী এবং নাগেশ্বরী থানার বিভিন্ন স্থানে হানাদারদের প্রতি আঘাত হানতে