পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৪৯

মনেও গভীর সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ পরিবর্তন এবং ঢাকার বৈঠকে যোগদানের ব্যাপারে ভুট্টোর অনীহা প্রকাশের ফলে বৈঠক অনিশ্চিত হয়ে পড়লে সারা দেশ ক্ষোভে উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। এই পটভূমিতে ১৬ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-ভুট্টো ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যে আলোচনা চলে স্বভাবতই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তা আমরা অনুসরণ করছিলাম। আমার ধারণা ছিল এই চরম সংকট ও অচলাবস্থা নিরসনে তারা হয়তো একটা সমঝোতায় উপনীত হবেন।

 অন্যদিকে সারাদেশে প্রতিদিনই জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা হচ্ছিল। ২৩ মার্চ বিকেলে চট্টগ্রাম শহরে ছাত্র-শিক্ষক জনতার একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয় ও প্যারেড গ্রাউণ্ডে গিয়ে মিলিত হয়। এই জনসভায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-শিক্ষক অনেকে গিয়েছিলাম। সভা চলাকালে খবর পেলাম, চট্টগ্রাম বন্দরে বাঙ্গালী শ্রমিকরা জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করায় পাক বাহিনীর জোয়ানরা গোলাবর্ষণ করেছে। এরপর সভা মূলতবী হয়ে যায়। চট্টগ্রাম শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসার সময় এক অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ প্রত্যক্ষ করি। তরুণ ও যুবকরা সেচ্ছাসেবকের প্রতীক নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে। দেখে মনে হল তারা পাক সামরিক অভিযান বাধা দিতে অকুতোভয় ক্যাম্পাসের দিকে এগুতে পারিনি। গ্রামের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে পথ খুঁজে নিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে পৌঁছতে অনেক রাত হয়েছিল।

 দেশের এই ক্রান্তিকালে যে কোন মুহূর্তে নতুন কোন ঐতিহাসিক অধ্যায়ের উন্মোচন হতে পারে এরূপ একটা অবস্থায় গভীর ঔৎসুক্য নিয়ে প্রতিদিন বেতারে খবর শুনলাম। ২৬ মার্চ সকালে রেডিও খুলতেই হঠাৎ অস্বাভাবিক অবস্থা মনে হলো। ভারী কণ্ঠ, যা কোন বাঙ্গালীর বলে মনে হয়নি, ঘোষণা শুনতে পেলাম, ঢাকাতে কার্ফিউ জারি হয়েছে, পরবর্তী ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করুন। সেই মুহূর্তে ঢাকায় কি ঘটছে তা জানা যায়নি। তবে সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে তা আঁচ করা যাচ্ছিল।

 দ্বিপ্রহরের পর থেকে আকাশবাণীর খবরে ঢাকার কিছু কিছু সংবাদ পেলাম ইপিআর ও পুলিশ ক্যাম্প পাক সেনারা আক্রমণ করেছে, নিরীহ জনসাধারণের ওপরও তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চড়াও হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অনেক পরিচিতজনের নিহত হওয়ার কথাও শুনলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে চট্টগ্রামে আমরা কি করব তা স্থির করতে পারিনি।

 ২৬ মার্চ রাত বারটার দিকে উপাচার্য ডঃ এ, আর, মল্লিক আমাকে ডেকে পাঠান এবং বলেন আরো যাকে পান সঙ্গে নিয়ে আসবেন। গিয়ে দেখি অনেক ইপিআর (তদানীন্তন ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল)-এর লোকজন রামগড় ও সন্নিহিত সীমান্ত এলাকায় তাদের স্থান ছেড়ে ক্যাম্পাসে এসে জড় হয়েছে। এদের খাওয়ার ব্যবস্থা করাই ছিল সেই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরী কাজ। আমাকে সেই দায়িত্ব দেয়া হলো। অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে গেলাম। চাল, ডাল, তরকারী ইত্যাদি সংগ্রহ করে তাদের খাওয়ার আয়োজন করা হল। এ অবস্থায় তারা কি করবে এই নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্ট আক্রমণ করা যায় কিনা এবং কি উপায়ে তা করা যাবে এ ব্যাপারে অনেক কথাবার্তা হল। উল্লেখ্য যে, এদের মধ্যে অফিসারের সংখ্যা ছিল কম।

 ডঃ মল্লিক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অবস্থা মোকাবেলার জন্য তার গোপন নির্দেশে আমরা মলোটভ ককটেল জাতীয় কিছু বোমা তৈরী করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে তিনি আমাকে সাহায্য করার জন্য সিএসআইআর-এর ডঃ আবদুর হাই-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। রসায়ন বিভাগের ডঃ মেসবাহউদ্দিন ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের এখলাস উদ্দীনের সহায়তায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরীতে আমরা এ ধরনের কিছু হাতবোমা তাৎক্ষণিকভাবে বানাতে সক্ষম হই এবং সেগুলো পরীক্ষামূলক ব্যবহার করি।