পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৫২

 মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ আট মাসে মাইনকার চর, মহেন্দ্রগঞ্জ ও ডালুতে ঘুরে ঘুরে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সামনে বক্তৃতা করে উদ্বুদ্ধ করতাম। তারা বজ্রশপথে মাতৃভূমি উদ্ধারকল্পে বাংলাদেশে ঢুকতো। নাটিয়াপাড়া, বাঐখোলা, পাটখাগুড়ি, বাসাইল, হাতিবান্ধা ও মিরিকপুরে ১২ জন নিহত হয়। এদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গণহত্যার স্থান ছিল মিরিকপুর, বাসাইল। আমার পালিত পুত্রের বাবা খন্দকার শামসুর রহমানকে শুধু আমারই পালক পুত্রের বাবা হওয়ার অপরাধে ধরে এনে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের সামনে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়।

 ৩রা এপ্রিল (যেদিন পাক বাহিনী টাঙ্গাইলে প্রথম ঢোকে) নাটিয়াপাড়াতে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তুমুল যুদ্ধ হয়। নাটিয়াপাড়া বাজার ও আশেপাশের বাড়িঘর পাক বাহিনী পুড়িয়ে দেয়। আমার স্ত্রী বেগম রিজিয়া খালিদ পাক বাহিনীর হাতে থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লজ্জায় অপমানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে চিকিৎসার জন্য তিনি ছদ্মনামে ঢাকা হলিফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হন। আমার প্রাক্তন ছাত্র (ডাঃ আবদুর রহমান) উক্ত হাসপাতালের ডাক্তার আমার স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারেননি। ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল শুক্রবার সকাল ন’টায় তিনি প্রাণত্যাগ করেন। মারা যাওয়ার প্রাক্কালে প্রকাশ পেয়ে যায় যে তিনি আমারই স্ত্রী এবং যখন তার লাশ টাঙ্গাইলে নেয়ার জন্য অনুমতি চাওয়া হয়, পাক বাহিনীর কাছে তা অগ্রাহ্য হয়। ফলে একদিন পর ৪ঠা ডিসেম্বর আজিমপুর গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। সে সময় ঢাকায় ভীষণভাবে বোমাবর্ষিত হচ্ছিল। আমার স্ত্রীর এই অকালমৃত্যুর খবর আমি ঘাটাইলে পাই ১৩ই ডিসেম্বর, সর্বপ্রথম যখন আমি ভারত থেকে টাঙ্গাইলের দিকে আসছিলাম। কাদের সিদ্দিকীর উপস্থিতিতে ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে সর্বপ্রথম যে জনসভা হয় সেই সভায় আমি কোরান তেলাওয়াত করি এবং মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দিই। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম জনসভা। এই সভায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আমি মোনাজাত পরিচালনা করি তাতে সমস্ত জনসভা যেন কান্নার রোলে ফেটে পড়ে।

অধ্যক্ষ
এমসিএ (সাবেক এম এন এ)
টাঙ্গাইল


মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ

 বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নওগাঁতেও স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার পুরোমাত্রায় এসেছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় শাখাসমূহ তাদের নিজ নিজ কেন্দ্রীয় সংগঠনের। নির্দেশ অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সংগ্রাম ছিল সত্যিকার অর্থেই জনতার সংগ্রাম। অন্যান্য এলাকার মত নওগাঁবাসীদের অবদানও এতে কোন অংশেই কম ছিল না। ২৬ শে মার্চের আগেই নওগাঁর বুকেও স্বাধীনতার প্রতীক বাংলাদেশের পতাকা নওগাঁবাসীরা উড়িয়েছিল।

 একাত্তরের ২৫শে মার্চের নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ ঘটনাবলীর খবর ঘটনার দু'একদিনের মধ্যেই টুকরো টুকরোভাবে বিভিন্ন সূত্রে নওগাঁতেও এসে পৌঁছেছিল। অনেকের মত আমারও কোন সন্দেহ ছিল না যে ঐ ঘটনা আমাদেরকে এক রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ঠেলে দিয়েছে।

 ঢাকা শত্রুকবলিত হওয়ায় ঢাকার সংবাদপত্রগুলো আর “আমাদের ছিল” না; ওগুলো দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর প্রচারপত্রে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে প্রচারণা চালাবার জন্য আমাদেরও পত্রপত্রিকার প্রয়োজন রয়েছে মনে করেই বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশেও রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমা শহরের হোটেল পট্টির পাশে কাজীপাড়ার ছোট একটি হস্তচালিত প্রেস থেকে ১৯৭১-এর ৩০শে মার্চ তারিখে ক্ষুদ্রাকৃতি এক পাতার দৈনিক “জয় বাংলা” বের করি। বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতার কণ্ঠে ধ্বনিত “জয় বাংলা” কথাটি