পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৫৪

কণ্ট্রোল রুমের রিটায়ার্ড সুবেদার দবিরউদ্দিন (ওস্তাদজী) ও হাবিলদার এমদাদুল হক ওরফে তোতাও এ ব্যাপারে সহায়তা করেন। এছাড়া রাইফেল বাহিনীর স্থানীয় কমাণ্ডার মেজর নাজমুল হকও এ বিষয়ে সহযোগিতা করেন।

 দেশের অন্যান্য সীমান্তের মত নওগাঁ সীমান্তেও তখন উন্মুক্ত ছিল। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকারও দু’এক কপি সীমান্ত পথে আমাদের হাতে আসতে শুরু করেছিল। “জয় বাংলা'র ১১শ সংখ্যায় ‘জবাসস সংগৃহীত এবং এসব পত্র পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত হয়ে কিছু সংবাদ ছাপানো হয়। অমৃতবাজার পত্রিকার ৯ই এপ্রিল তারিখের সংবাদে জানতে পারি যে, ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’ ও ‘দি পিপল’-এর কার্যালয়গুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং বেশ কিছু সাংবাদিক ও কর্মচারীদের হত্যা করা হয়েছে। আরও জানি ‘দি পাকিস্তান অবজারভার’, ‘দি মনিং নিউজ’, দৈনিক পাকিস্তান', 'আজাদ', ও পূর্বদেশ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছাপা হচ্ছে। ‘জয় বাংলা’য় এ খবর উদ্ধৃত করে মন্তব্য করা হয়- “পশ্চিমা বর্বরেরা বিশ্বকে ধোঁকা দিবার জন্য উক্ত বিখ্যাত পত্রিকাগুলির নাম বা Goodwill ব্যবহার করিতেছি।” এই সংখ্যায় জনপ্রিয় সংবাদপত্রগুলোর অফিস ধ্বংস ও সাংবাদিক হত্যার নিন্দা করা হয়।

 হানাদারদের আক্রমণের ভয়ে নওগাঁ শহর তখন প্রায় ফাঁকা। কাজীপাড়ার যে ছোট প্রেস থেকে ‘জয় বাংলা’ ছাপা হচ্ছিল তার কর্মচারীদের অনেক বলে-কয়েও নওগাঁ থাকতে রাজী করান যাচ্ছিল না। সকলের মনেই ভীতি, -এই বুঝি হানাদাররা এসে পড়ে। অন্যান্য প্রেসও বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে ‘জয়বাংলা' আর ছাপানো সম্ভব হয় নি।

 ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতর কিংবা বাইরে থেকে ‘স্বাধীন বাংলা’র আর কোন দৈনিক পত্রিকা ছাপা হয়নি। দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের নাম দিয়ে বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় একাধিক সাপ্তাহিক/পাক্ষিক ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু ‘দৈনিক’ একটিও বের হয়নি।

 নিজস্ব সীমিত পুঁজির ওপর নির্ভর করেই “জয় বাংলা’ প্রকাশের কাজে হাত দিয়েছিলাম। কারও কাছ থেকে কোন আর্থিক সাহায্য নেবার প্রয়োজন হয়নি। প্রেস কর্তৃপক্ষও কোন লাভ নিতেন না, শুধু কাগজ ও মুদ্রণের খরচ নিতেন। ‘জয় বাংলা’র প্রথম সংখ্যার মূল্য ১০ পয়সা ধার্য হয়েছিল। এক ঘণ্টায় ২০০ কপি বিক্রিও হয়েছিল। কিন্তু এ সামান্য দাম আদায়ে ঝামেলার কারণে প্রথম সংখ্যার অবশিষ্ট কপি ও দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে শেষ সংখ্যার সকল কপিই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল।

 ‘জয় বাংলা'র প্রথম সংখ্যাটি ছাপা হয়েছিল ১০০০ কপি। পরবর্তী সংখ্যাগুলোর কোনটা ১,৫০০ কোনটা ৩,০০০ কপি ছাপা হয়। সর্বমোট কপি সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০,০০০। খুলনা নিউজপ্রিণ্টের হাফ ডিমাই সাইজের কাগজে জয় বাংলা ছাপানো হত। প্রথম কয়েক সংখ্যা এক পাতার এক পাশে এবং অবশিষ্টগুলো এক পাতার দু'পাশে ছাপা হতো। ঐ পরিস্থিতিতে ছোট হাতে চালানো প্রেস থেকে এর চেয়ে বড় আকারে পত্রিকা বের করা কোনমতেই সম্ভব ছিল না।

 ‘জয় বাংলা’র প্রথম সংখ্যাটি আমি নিজে আমার স্কুলজীবনের সহপাঠী জাহিদ হোসেনকে সাথে নিয়ে নওগাঁ শহরে বিলি করেছিলাম- ৩০শে মার্চ, ১৯৭১ তারিখে। এ পত্রিকা প্রকাশকালে নওগাঁর তৎকালীন এম এন এ জনাব বায়তুল্লাহ (পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার), নওগাঁ, রাজশাহী ও বগুড়া মুক্তাঞ্চলের তৎকালীন কমাণ্ডার রাইফেল (ইপিআর) বাহিনীর মেজর নাজমুল হক, বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের আরও অনেকেই উৎসাহ দিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন। মেজর হকের অনুমতিক্রমেই তার বাহিনীর যানবাহনে নওগাঁর বাইরে ‘জয় বাংলা’র বাণ্ডিল পাঠানো সম্ভব হয়েছে।

 এপ্রিলের মাঝামাঝি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মুক্তাঞ্চলের একে একে আমাদের হাতছাড়া হতে থাকে। পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া ও অন্যান্য শহরগুলোতে হানাদার বাহিনী ধীরে ধীরে তাদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে