সক্ষম হয়। আমাদের অসংগঠিত, বিশৃংখল, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণবিহীন এবং উপযুক্ত অস্ত্রবিহীন বাহিনী প্রথম পাল্টা আক্রমণেই পশ্চাদপসরণ করতে এবং নিরুপায় হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও আপৎকালীন জরুরী ব্যবস্থার কোন পরিকল্পনা না থাকায় কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বও সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে, বলা চলে সাময়িকভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং এরই ফলে হানাদারদের হামলার মুখে সারাদেশ জুড়ে শুরু হয় মাঠঘাট, বন-বাদড়, নদী-নালা, টিলা-পাহাড় পেরিয়ে পরিকল্পনাহীনভাবে সকলের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য প্রাণান্তকর ছুটাছুটি। সীমান্ত নিকটবর্তী শহর নওগাঁতেও এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি।
১৪ই এপ্রিল সকালে রাইফেল বাহিনীর গোলাবারুদসহ রাজশাহীগামী দুটি জীপের কনভয়ে রাজশাহী যাত্রা করি। অধিকাংশ রাস্তাই কাঁচা। দুপুরের আগেই নদীর তীরে কালিকাপুর পৌঁছি। নদীর ওপারে মান্দা। নৌকায় জীপ পারাপারের ব্যবস্থা ছিল। সেখানেই রাজশাহী এলাকা থেকে জীপ যোগে ফিরে আসা নওগাঁ এলাকার সেক্টর কমাণ্ডার মেজর নাজমুল হকের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি রাজশাহী শহর হাতছাড়া হবার খবর দেন এবং কনভয়ে কয়েকজন সৈন্যকে একটি জীপ নিয়ে ঐ এলাকায় অবস্থানরত ক্যাপ্টেন গিয়াসের সঙ্গে যোগ দেবার নির্দেশ দিয়ে অপরটিকে তার সঙ্গে নওগাঁ ফিরতে বলেন। রাজশাহী যাওয়া সম্ভব না বলে আমাকেও তার জীপে তুলে নেন। দুপুর ২টার দিকে আমরা নওগাঁর বলিহার হাউজে ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসি। জীপে বসে মেজর হককে আমি নওগাঁ ঘাঁটি রক্ষার্থে সম্ভাব্য হামলার রাস্তাসমূহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তার অধীনস্থ সৈন্য এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় প্রতিরক্ষা ব্যূহের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করি। তিনি নিরাসক্তভাবে আমার বক্তব্য শোনেন। রাজশাহী হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার তিনি অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং শিগগিরই নওগাঁ আক্রমণের আশঙ্কা করছিলেন। হাতিয়ারের জন্যও তিনি চিন্তিত ছিলেন। যে কয়েকটা মেশিনগান তার বাহিনীর হাতে ছিল সেগুলোরও ফায়ারিং পিনের অভাব দেখা দিয়েছিল। হানাদারদের অস্ত্রবলের ধারণা তার ছিল কেননা মূলত তিনি আর্টিলারী কোরের সদস্য ছিলেন কিন্তু রাইফেল বাহিনীর সঙ্গে ডেপুটেশনে যুক্ত ছিলেন। সম্ভবত এসব কারণে আমার মত যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ব্যক্তির প্রস্তাবে তার কোন ভাবান্তর হয়নি। এরপরে সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সকলের মনেই নানারকম আশঙ্কা। প্রায় ফাঁকা নওগাঁ শহর বিকেলের মধ্যেই আরও ফাঁকা হয়ে যায়।
বিকেলে মেজর হকের সঙ্গে আবার দেখা করি। তাঁকে জিজ্ঞাসা করি আমাদের প্রতিবেশী দেশ থেকে কোন অস্ত্র সাহায্য পাচ্ছেন কিনা। তিনি বলেন, এখনো তো তেমন কিছু পাচ্ছি না। আমি তখন তাঁকে সীমান্তের ওপারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করব কিনা জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তাঁর সাথে আলোচনায় এবং হেডকোয়ার্টারের তেড়জোড় দেখে আমার বুঝতে বাকী রইল না যে কোন মুহূর্তে তিনি ঘাঁটি ত্যাগ করবেন। সন্ধ্যার পর সংগ্রাম পরিষদের অফিসেও আর কাউকে পাওয়া গেল না। সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। 'মুক্তি' সিনেমার রাস্তার মাথায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জটিতে তখনও একজন অপারেটর ছিলেন। সেখান থেকে রাতে বলিহার হাউজের রাইফেল বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে ফোন করে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। এ পরিস্থিতিতে আমি অপারেটরের সহায়তায় পাঁচবিবি, আত্রাই, জয়পুরহাট ও পত্নীতলা পিসিও বগুড়া সার্কিট হাউজে অবস্থিত বগুড়া কণ্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং রাজশাহীর সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর দিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেই। নওগাঁর পরিস্থিতির ইংগিত দেই। পরদিন ১৫ই এপ্রিল সকালে হেডকোয়ার্টার শূন্য থাকার খবর পাওয়া গেল। আগের রাতেই রাইফেল বাহিনীর হেডকোয়ার্টার অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। শহরও প্রায় শূন্য। প্রেসও বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে আমার শহরে থাকা মানে হানাদারদের হাতে পড়ে খামাখা জান দেয়া বিধায় একটি ব্যাগে কাগজপত্র ও একসেট বাড়তি কাপড় নিয়ে আমার বাসা-কাম-‘জয় বাংলা’র দফতরে তালা ঝুলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। সীমান্ত এলাকায় তখন সুযোগমত লুটপাটের প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। দু'এক জায়গায় সন্দেহজনক লোকদের তথাকথিত ‘চেকপোষ্টে’ আমার পরিচয় দিয়ে দলসহ ১৫ই এপ্রিল রাত প্রায় ১১টার দিকে প্রহরাবিহীন নওগাঁ-পশ্চিম দিনাজপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করি। ভারতে এটাই ছিল আমার প্রথম প্রবেশ।