পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৫৬

ভারতে প্রবেশের কিছুদিন পরে কোলকাতা প্রেসক্লাবের সেক্রেটারীসহ কয়েকজন সদস্য আমাকে কোলকাতা থেকে ‘জয় বাংলা’ পুনঃপ্রকাশের পরামর্শ দেন। মুক্ত বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ সম্ভব হলে পুনরায় মুক্ত বাংলাদেশ থেকেই প্রকাশিত হবে তাদেরকে আমার এ সিদ্ধান্তের কথা জানাই।

 ভারত থেকে পরবর্তীকালে অন্যান্য বাংলাদেশী সাংবাদিকেরা বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক/পাক্ষিক পত্রিকা বের করেছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১১ই মে, ১৯৭১ তারিখে দলীয় মুখপাত্র ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলা’ প্রকাশ করেন। প্রকাশস্থলের নাম দেয়া হয় ‘মুজিবনগর'। কোলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকার ২১/এ বালুহাক্কাক লেনে এ পত্রিকার দফতর ছিল। কোলকাতাসহ ভারতের পত্রপত্রিকায় আমার ক্ষুদে ‘দৈনিক জয়বাংলা'র ব্যাপক প্রচার হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ কর্তৃপক্ষ তাদের পত্রিকার নামও ‘জয় বাংলা’ রাখেন। এই দলীয় মুখপত্রটির সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক ছিল না। ‘জয় বাংলা সংবাদ সংস্থা (জবাসস)' নামটি অবশ্য আর কেউ ব্যবহার করেননি।

 একাত্তরের ১৫ই এপ্রিল মধ্যরাতে আমি ভারতের বালুরঘাট শহরে পৌঁছি। এটি পশ্চিম বাংলা রাজ্যের পশ্চিম দিনাজপুর জেলা সদর। পরদিন ১৬ই এপ্রিল নওগাঁয় মেজর হকের সঙ্গে ১৪ই এপ্রিলের আলোচনা মোতাবেক স্থানীয় এম এল এ শ্রী বীরেশ্বর রায় এবং পশ্চিম দিরাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার কথা জানাই। উভয়েই জানালেন বিষয়টি উচ্চতর কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। আমাদেরকে সক্রিয়ভাবে কোন সাহায্য দানের ব্যাপারে তারা কিছুই অবগত নন। এরপরে ঐ দিনই খবরের কাগজ কিনে বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ ও ইংরেজী দৈনিক ‘অমৃত বাজার’ পত্রিকার টেলিগ্রাফিক ঠিকানা সংগ্রহ করে বালুরঘাট থেকে ‘জবাসস' নাম দিয়ে একটি রিপোর্ট পাঠাই। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই কোলকাতা পৌঁছে গেছেন এবং পরদিন ভোরে এক্সপ্রেসে বাসে বালুরঘাট থেকে কোলকাতা রওয়ানা হই। কোলকাতায় পৌঁছে পত্রপত্রিকায় মুজিবনগর সরকার গঠনের খবর দেখলাম।

 কোলকাতা আগে কখনও যাইনি। কাউকে চিনিও না। স্টেশন থেকে ট্রাক্সী নিয়ে সোজা 'যুগান্তর’ পত্রিকার অফিসে গেলাম। সম্পাদক শহরে ছিলেন না। বার্তা সম্পাদক কবি শ্রী দক্ষিণারঞ্জন বসুর ঠিকানা নিয়ে তার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং তাকে ‘জয় বাংলা’র কপিগুলো দেই। প্রবীণ সাংবাদিক শ্রী বসু সস্নেহে আমাকে গ্রহণ করে সব খবরাখবর নিলেন। তার বাসায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ঠিকানা সংগ্রহ করে কোলকাতা বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সঙ্গে যুক্ত প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী তারাশংকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং ‘জয় বাংলা’র কপি উপহার দেই। তিনি সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলেন। এরপরে চৌরঙ্গীর কিড স্ট্রীটের স্টেট গেস্ট হাউজে যাই এবং ইনচার্জকে অনুরোধ করে রাতের জন্য একটি রুম পাই।

 পরদিন ১৯শে এপ্রিল সকালেই বাংলাদেশ মিশনে গিয়ে জনাব হোসেন আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং নওগাঁ এলাকার বিস্তারিত খবর জানাই। তাকে বলি এখনও চেষ্টা করলে নওগাঁ এলাকাটি আমাদের দখলে রাখা সম্ভব। তাকে আরও জানাই সক্রিয় সাহায্য পেলে আমাদের বাহিনী বাংলাদেশের সমগ্র উত্তরাঞ্চল দখলে রাখতে পারে এবং আমাদের সরকারও দেশের অভ্যন্তর থেকেই কাজ চালাতে পারে। তিনি আমাকে সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করার জন্য একটি লিখিত রিপোর্ট দিতে বলেন। আমি তখন মিশনের টাইপিষ্ট দিয়ে দেশে থাকাকালীন মুদ্রিত ‘জবাসস’ -এর প্যাডে একটি রিপোর্ট টাইপ করিয়ে দুই কপি জনাব হোসেন আলীকে দেই। জনাব হোসেন আলী এ রিপোর্টটি আমাদের কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেবেন বলে আমাবে বলেন। আমার কাছে কোন বৈধ ট্রাভেল ডকুমেণ্ট নেই বিধায় আমাকে মিশন থেকে একটি পরিচয়পত্র দেয়া হয়। একই দিনে মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারী জনাব আর আই চৌধুরী, প্রেস এ্যাটাশে জনাব মকসুদ আলীর সঙ্গেও পরিচয় হয়। এর ৩/৪ দিন পরে পুনরায় জনাব হোসেন আলীর সঙ্গে মিশনে সাক্ষাৎ হলে তিনি আমাকে জানান ১৯ তারিখের ‘জবাসসে’র রিপোর্টটি তিনি আমাদের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে পৌঁছে দিয়েছেন।