আগষ্ট মাসে খবর বের হয় যে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের বিচার করবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিবেকবান ব্যক্তিরা এর প্রতিবাদ করেন। ভারতের বিভিন্ন জায়গাতেও প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। উত্তর ভারতের বেনারসেও ইনষ্টিটিউট-এর যুগ্ম পরিচালক শ্রী সুগত দাস গুপ্তের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্যদের প্রায় এক মাইল দীর্ঘ এক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। আমিও এতে যোগ দেই। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিরও অনেকে এত অংশ নেন।
সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে বেনারসে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। এই সাক্ষাৎকালে শ্রী নারায়ণ আমাকে বলেন, ভারতের অবাঙ্গালী অধ্যুষিত অনেক এলাকাতেই পাকিস্তানপন্থীরা আপনাদের বিরুদ্ধে ২৫শে মার্চের আগেই বাংলাদেশে ব্যাপকহারে বিহারী নিধনের অভিযোগ করে প্রচার চালাচ্ছে। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে আপনাদের স্বপক্ষে বক্তব্য রাখবার সময় আমাকেও মাঝে মাঝে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। এ অভিযোগ কতটা সত্যি? আমি তাকে জানাই ২৫শে মার্চের আগে বাঙ্গালীরা এ ধরনের কাজ ব্যাপক হারে করেছে এ অভিযোগ সত্য নয়। দু'এক জায়গায় এ ধরনের ছোটখাটো ঘটনা অবশ্য ঘটেছে তাতে উভয় পক্ষেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে এটাকে ব্যাপক বিহারী হত্যা কোন মতেই চলা চলে না। কোন কোন এলাকায় বাঙ্গালীরাই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছে। তবে ২৫শে মার্চে পাকিস্তানী গণহত্যা শুরুর পরে আমাদের দখলাধীন কোন কোন জায়গায় কিছু বাড়াবড়ি হয়েছে সেটা সত্য। তবে তার জন্য দায়ী হানাদারেরা এবং তাদের সহযোগী বিহারীরা। এর উত্তরে তিনি বলেন, ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঘটনা সম্পর্কে আমি আপনার কাছ থেকে নিশ্চিত হলাম। ২৫শের পরের ঘটনার দায়-দয়িত্ব তো পাকিস্তানীদের। যদিও পাকিস্তান সরকার তাদের ‘শ্বেতপত্রে’ আমাদের ঘাড়েই আবার দোষ চাপিয়েছে।” এর পরে তিনি আমাদের ১ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঢাকা, পশ্চিম পাকিস্তান এবং কিছু নামকরা বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে এ অভিযোগ খণ্ডন করে ব্যাপক প্রচারের জন্য একটি রিপোর্ট তৈরী করার চেষ্টা করতে বলেন। তিনি বলেন, এ রিপোর্ট ভাবাবেগবর্জিত এবং নিরপেক্ষ হতে হবে। এ আলোচনার পরদিন ২৪শে সেপ্টেম্বর বিদেশী পত্রিকার ঐ সময়ের কপি খুঁজবার জন্য দ্বিতীয়বার দিল্লী যাই। আমার রিপোর্ট প্রণয়নের জন্য আমি দিল্লীর ইণ্টারন্যাশনাল স্টাডিজ লাইব্রেরী, বৃটিম হাইকমিশন লাইব্রেরী এবং ইউ,এস, আই,এস লাইব্রেরীতে ঢাকা, পিণ্ডি, প্যারিস, লণ্ডন ও নিউ ইয়র্কের প্রধান প্রধান পত্রিকাসমূহ অনুসন্ধান করি।
এসব পত্রিকার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে “Pakistani Propaganda - Is it based on Facts?” নামে একটি তথ্যমূলক পুস্তিকা রচনা করি। এতে পাকিস্তান সরকারের “শ্বেতপত্রে” বিহারী নিধনের অভিযোগও খণ্ডন করা হয়ে। আমাদের কোলকাতা মিশনও আমার এ কাজে আগ্রহ দেখান এবং এ রিপোর্টের কপি পাঠাবার অনুরোধ জানান। আমি যথাসময়ে তা পাঠাই। ইনষ্টিটিউট থেকে মুদ্রিত করে এ রিপোর্টটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। আমিও ডাকে আমরা বিভিন্ন সাংবাদিক বন্ধুর কাছে এটি পাঠাই।
নভেম্বর মাসে পুনরায় কোলকাতা আসি। এ সময়ে জানতে পারি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী কোলকাতায় অবস্থান করছেন। আমি শিশন থেকে ঠিকানা নিয়ে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র স্ট্রীটের হোটেল পূর্বরাগে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। অনেক আলোচনা হয়। তিনি তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের রূপরেখা প্রণয়নে ব্যস্ত ছিলেন।
ইতিমধ্যেই ভারত সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতা অনেক বৃদ্ধি পায়। এবারে কোলকাতা থেকে শিলিগুড়ি হয়ে মেঘালয় সীমান্ত পথে দেশের অভ্যন্তরে ঢোকার প্রস্তুতি নিয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাই। ততদিনে সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে শিলিগুড়ি থেকে ফের কোলকাতা ফিরে এলাম। সীমান্তে জোরেশোরে লড়াই চলছে শুনে নভেম্বরের শেষে কোলকাতা ছেড়ে নওগা ঁসীমান্ত নিকটবর্তী ভারতীয় শহর বালুরঘাট রওয়ানা হই। কিন্তু বালুরঘাটে তখন পাকিস্তানী শেলিং-এর কারনে শহর প্রায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল বলে মালদা থেকে পুনরায় কোলকাতা ফিরে আসি। খবর পাই ভারতীয় নিয়মিত বাহিনী