পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড

 ২৭শে মার্চ ও ২৮শে মার্চ ই, পি, আর-এর আরও কিছু জওয়ান এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে আত্মরক্ষা করে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কিছু সৈন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত এদের সংখ্যা দাঁড়ায় চারশ’র বেশী। কিন্তু ই,পি, আর ও ই,বি,আর-এর জওয়ানদের একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয়। এস,পি, শামছুল হক, মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার সঙ্গে আমার টেলিফোনে যোগযোগ ছিল। পরস্পরের কাছে পরিচিত হবার জন্য আমরা ভিন্ন কিন্তু নির্দিষ্ট নাম ব্যবহার করতাম। আমাকে দেয়া নাম ছিল ‘ডানিয়েল’। যোগাযোগ করা ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠেছিল, কেননা ক্রমেই তাঁদের অবস্থান এমন জায়গায় হচ্ছিল যেখানে টেলিফোনে কথা বলা যাচ্ছিল না। যাহোক, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থানরত জওয়ানদের যুদ্ধ ব্যাপারে নেতৃত্ব দেবার জন্য আমি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ক্যাপ্টেন রফিক-এর মারফত চেয়ে পাঠাই। তাঁরা পাঠান একজনকে। (পরে দেখি তিনি আমার পূর্ব পরিচিত ও আমার বড় ছেলের বন্ধু)। তাকে নিয়ে একটা ভূল বুঝাবুঝি হয়। তিনি সরাসরি আমার অফিসে এসে জওয়ানদের দায়িত্ব গ্রহণ না করে, ক্যাম্পাসে আমার সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র দেখে আরো অস্ত্র সংগ্রহের জন্য বর্ডারে যাবার কথা বলেন এবং এ ব্যাপারে কর্তব্যরত অধ্যাপকের কাছে একটি গাড়ী চান। অধ্যাপক একথা আমাকে ফোনে জানান। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া কিংবা মেজর জিয়া যে তাকে পাঠিয়েছেন তা তিনি জানালেও আমরা সরাসরি কোন খবর কালুরঘাট থেকে পাইনি বলে উক্ত অফিসার সম্বন্ধে আমাদের সন্দেহের উদ্রেক হয়। তখন তাকে আমি আমার অফিসে ডেকে পাঠাই এবং জিজ্ঞাসাবাদ করি। তাতেও সন্দেহ নিরসন না হওয়াতে ই,পি,আর-এর নায়েক এবং দুই সিপাহীর সাহায্যে তাকে এবং তার দু’জন সহচর ছাত্রকে নিরস্ত্র করি এবং ভাইস চ্যান্সেলরের ভিজিটরস রুমে পাহারাধীন রাখি। তাদের উদ্দেশে আমি বলি যে দেশ এক সংকটময় পরিস্থিতিতে জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত। এ অবস্থায় কারও চালচলনে সন্দেহের উদ্রেক হলে তাকে নজর বন্দী রাখতে হয়। মেজর জিয়ার ক্যাম্প থেকে তাদের সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করে তারপর সিদ্ধান্ত নেব। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়াকে ফোনে যোগাযোগ করি। তিনি বলেন যে, উক্ত অফিসারকে দু’জন ছাত্রসহ পাঠিয়েছি। আমার বক্তব্য, তাই যদি হয়, তবে আমার সংগে দেখা না করে এখানকার দায়িত্ব না নিয়ে চলে যাচ্ছিল কেন। যাহোক, তখন ঐ অফিসারকে মুক্ত করে আমি জিয়ার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেই এবং অন্য কোন সিনিয়র অফিসার পাঠাতে অনুরোধ করি। সঙ্গের দু’জন ছাত্রকেও তার সঙ্গে পাঠাই কারণ এটা প্রমাণিত হয় যে, তারা প্রতিরোধ সংগ্রামে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিতে মেজর জিয়ার ক্যাম্পে গিয়েছিল। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার নির্দেশে অফিসারকে নিয়ে আমাদের এখানে আসে। তারা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত নয়। ছাত্রদের পরিচিতি সম্বন্ধে স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে[১] খবর নিয়ে জানতে পারি যে, তাদের বক্তব্য সত্য। তখন ঐ দুটি ছাত্রকে দিয়ে উক্ত অফিসারকে কালুরঘাট পাঠানো হয় ক্যাপ্টেন রফিকের নিকট। ছাত্র দুটি যখন ফিরে আসছিল তখন তারা পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, ক্যাম্পাস থেকে সংগ্রাম পরিচালনার সময় আমাদের ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দুইজন সদস্য আব্দুর রব (তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক) এবং ফরহাদ কাপ্তাই রোডের ওপর এক গেরিলা অপারেশনে মৃত্যুবরণ করে।

 ২৯শে মার্চ সেনাবাহিনী ও পুলিশের অফিসারদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। মনে হয় তারা অবস্থান পাল্টেছেন, কিন্তু আমাদের খবর দেবার সময় পাননি।

 পক্ষান্তরে আমরা চট্টগ্রাম শহরের পতনের সংবাদ পাই। ইতিমধ্যে শত্রুর গুলিতে পরিখায় অবস্থানরত আমাদের কয়েকজন জওয়ান আহত হয়। এমতাবস্থায় প্রতিরোধ এখান থেকে জোরদার করা সম্ভব নয় বলে জওয়ানদের পক্ষ থেকে আরও উত্তরে চলে যাবার প্রস্তাব আসে। আমরা একমত হই। তারা নাজিরহাটে যাবে সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের সঙ্গে অবস্থানকারী জওয়ানরা গন্তব্যস্থলের দিকে রওয়ানা হয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে ডাঃ আবুল বাশার ও ডাঃ আখতারুজ্জামানের চিকিৎসাধীন কয়েকজন আহত যোদ্ধা ছাড়া তখন আর প্রায় কোন যোদ্ধাই আমাদের হাতে রইল না। এর পরে শহর থেকে গ্রাম্য পথ ঘুরে যোদ্ধৃবেশে


  1. জনাব আখতারুজ্জামান তাদের মধ্যে একজন