পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড

কিছু আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতা এবং ইউ, ও, টি, সির কিছু প্রশিক্ষণরত ছাত্র ও অফিসার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছান, কিন্তু ক্যাণ্টনমেণ্ট অবরোধ করে রাখা অসম্ভব দেখে তারাও অন্যত্র চলে যান। এদিকে ক্যাম্পাস থেকে উত্তর চট্টগ্রাম বা রাঙ্গামাটির রাস্তায়ও স্থানীয় জনসাধারণ ব্যারিকেড স্থাপন করতে শুরু করে। এই অবস্থায় আমরা স্থির করি যে ৩০শে মার্চ ক্যাম্পাস থেকে সকল শিশু, বৃদ্ধ ও নারীকে স্থানান্তরিত করা হবে। কয়েকটি বাসে করে কিছু পরিবার নাজিরহাটে পাঠিয়ে দেয়া হয়, অন্যেরা গিয়ে আশ্রয় নেন কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের হষ্টেলে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের বেতন বন্ধ ছিল কারণ হাতে টাকা ছিল না এবং ব্যাংক বন্ধ ছিল। কিছু কর্মচারী ব্যাংকের দরজা ভেঙ্গে টাকা নেয়ার প্রস্তাব করে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিই এবং ব্যাংক লুট করা চলবে না বলে দিই। আমার বাসায় যে ব্যাক্তিগত টাকা ছিল[১] সেখান থেকে চার হাজার টাকা নিয়ে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের বাড়ী যাবার ভাড়া তাৎক্ষণিকভাবে দিয়ে দিই এবং তাদের যার যার বাড়ীতে চলে যেতে বলে তাদের কাছ থেকে আমি বিদায় নিই। ৩১শে মার্চ রাতে ক্যাম্পাস প্রায় খালি হয়ে যায়। ডাক্তার দু’জনের হাতে চিকিৎসাধীন চার পাঁচজন যোদ্ধাকে রেখে ১লা এপ্রিল সন্ধ্যায় আমার পরিবার, রেজিষ্টারের পরিবার এবং আনিসুজ্জমানকে[২] নিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করলাম। আমি সপরিবারে রাউজানে আশ্রয় নিলাম। ক্যাম্পাসে ভি, সির বাসগৃহ ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় আমার সেক্রেটারী ইনস্যুরেন্স পলিসি, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদির কিছু কাগজপত্রের ক্যক্তিগত ফাইল আমার পাসপোর্টসহ আমার সামনে এনে হাজির করে সঙ্গে নেবার জন্য। আমি ওই পাসপোর্ট সবার সামনে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম কারণ, তখন আমি আর পাকিস্তানী নই, তাই পাকিস্তানী পরিচয়ে কোন পাসপোর্ট সঙ্গে রাখতে চাইনি। অন্যান্য কাগজপত্রের ফাইলটিও ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, যতক্ষণ না দেশ স্বাধীন হচ্ছে ততক্ষণ কোন বীমা, কোন শেয়ার সার্টিফিকেটের দরকার নেই। পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীন হবার পর আমার সেক্রেটারী ঐ ছুড়ে দেয়া ফাইলটি আমার ড্রাইভারকে দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।

 রাউজানে আমি সপ্তাহখানেক ছিলাম। ইতিমধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের প্রতিকূলে চলে যায়। সকলেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করতে থাকে। কুণ্ডেশ্বরীতে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েন। সেখানে আশ্রয় দাতা নূতনচন্দ্র সিংহের পরিবারও স্থান ত্যাগ করেন। নূতন বাবু শূন্য গৃহে রয়ে যাবার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পরে ১৩ই এপ্রিল হানাদার বাহিনী তাকে হত্যা করে।

 সম্ভবত ৮ই এপ্রিল আমি রাউজান থেকে নাজিরহাটে চলে যাই। ওখানে তখন আমাদের সহযোগী জওয়ানরা ছিলেন। সেখানে এক রাত তাদের সঙ্গে থেকে রামগড়ের পথে রওয়ানা হই। সপরিবারে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক রশিদুল হক ও ডঃ মাহমূদ শাহ কোরেশী আমার সঙ্গে আসেন। উল্লেখ্য নাজিরহাট থেকে আমার সঙ্গে যায় মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজন, তাদের সঙ্গে কালুরাঘাট থেকে সরিয়ে আনা ট্রান্সমিটার সেট ছিল। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধাও ছিল।

 ১০ই এপ্রিলে হানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করে। ১১ই থেকে ১৪ই এপ্রিলের মধ্যে রামগড়ে সপরিবারে এসে পৌঁছান অধ্যাপক শামসুল হক, ডঃ আনিসুজ্জমান, ওসমান জামাল; অন্য শিক্ষকদের মধ্যে ‘ষরিৎকুমার সাহা, নূরুল ইসলাম খোন্দকার প্রভৃতি এবং বেশ কিছু ছাত্র। ছাত্রেরা অনেকেই সাবরুম হয়ে ভারতে প্রবেশ করে এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ দু’চার দিনের সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এসে শত্রুও মোকাবিলা করে। আমাদের ছাত্র শহীদ ইফতিখার ছিল তেমন একজন।

 রামগড়ে এসে মেজর জিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনারায় স্থাপিত হয়। সেখানে থেকেই তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেজর শামসুদ্দীন (ই পি আর), ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন আফতাব (গোলন্দাজ


  1. উল্লেখ্য, আমার ব্যক্তিগত গাড়ী বিক্রয়ের দশ হাজার টাকা ব্যাংক বন্ধ থাকায় বাসায় ছিল।
  2. তার পরিবার আগেই কুণ্ডেশ্বরীতে স্থানান্তরিত হয়েছিল।