পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৯৫

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড

 ছাব্বিশ তারিখের সকালে ইয়াহিয়ার বক্তৃতা বিশু করে দিল; সাহস ফিরে পেলাম পরদিন মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনে। পরবর্তী এক মাস বাড়িতে কাটালাম। আমার বাড়ি কুমিল্লা শহর থেকে ছুই মাইল উত্তরে; ভারত-সীমান্ত থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে এবং রেল লাইনের একেবারে লাগোয়। সুতরাং পাকিস্তানী সেনাদের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া প্রতিদিন দেখলাম।

 মে মাসের প্রথম দিকে বুঝলাম; আমাদেরও বাড়ি ছাড়তে হবে। আমাদের বাড়ির মাইলখানেক উত্তরে ফকিরহাট রেল স্টেশন। ওখানে ঘাঁটি পেতেছে প্রাকিস্তানী সেনাবাহিনী। তারা কুমিল্লা শহরে আসাযাওয়া করে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে। দেশ থাকা আর নিরাপদ মনে হল না। মে মাসের শেষ দিকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতেই চলে যাই।

 দেশত্যাগ করে প্রথমে উঠলাম আত্মীয়ের বাড়িতে। ওখানে ছিলাম সপ্তাহখানেক। নিকটস্থ বক্সনগর মুবশিবির প্রতিদিন যেতাম ও দেখতাম মুক্তিযোদ্ধাদের শারীরিক কসরৎ। ক্যাম্পের পরিচালকমণ্ডলীর সঙ্গে পবিচয় হল। শিবির প্রধান অধ্যাপক আবুর রউফ আমার পুরনো পরিচিত। আমি চিন্তা করলাম আগরতলা যাবার | একদিন যুবশিবির থেকে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে ভোরবেলা রওয়ানা হলাম আগরতলার উদ্দেশ্যে। পার্বত্য ঘন জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসীদের অধ্যুষিত এলাকার ভেতর দিয়ে প্রায় পনের মাইল হেঁটে দুপুরের দিকে শহরে উপনীত হলাম। আগেই জেনেছিলাম যে কলেজের মধ্যে পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্রের সমন্য়কারীদের কয়েকজনের অফিস আছে- তাদের একজন ছিলেন আবদুল মান্নান চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আমার পুরানো বন্ধু। বিকালে দিকে মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল এবং তিনি আমাকে পাঠালেন সোনামুড়ায়; রাজনৈতিক যুবকর্মীদের কেন্দ্রস্থল। সেখানকার প্রধান ছিলেন সৈয়দ রেজাউর রহমান-তিনিও ছিলেন আমার পূর্বপরিচিত। তিনি এবারে আমাকে পাঠালেন হাতিমারা ঘুবশিবির; শিবির প্রধানের কাছে চিঠি দিয়ে। সোনামুড়ায় একরাত কাটিয়ে পরদিন দুপুর বেলা আমি হাজির হলাম শিবিরে। যথারীতি অন্তর্ভূক্ত হলাম শিবির সদস্যরুপে। শুরু হলো নতুন জীবন।

 বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রাজনীতির প্রত্যক্ষ কার্যকলাপে আমার কোন যোগ ছিল না: তবে বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলাম মিছিলে; মিটিংয়ে। বিভিন্ন সংগঠনের মতপার্থক্য সম্বন্ধে জানলেও তার তীব্রতা আগে বুঝিনি।

 হাতিমারা পার্বত্য ত্রিপুরার একটি পরিচিত অঞ্চল। জঙ্গল বেশ ঘন গভীর। উচু নিচু টিলা মধ্যে প্রবাহিত ছোট্ট নালা, মাঝে মাঝে টিলায় পার্বত্য উপজাতি টিপরাদের বসতি। নিকটেই একটি বাজার ও প্রাইমারী বিদ্যালয়।

 রাস্তার আমান্য দূরে শিবির। প্রথম শিবিরের প্রধান ফটক। ভেতরে সারি সারি ব্যারাকসমূহ। শাল গাছের খুটি, বাঁশের বেড়া ও শনের ছাউনি দিয়ে দীর্ঘ ব্যারাকসমূহ তৈরি। চারপাশে ছোট ছোট ঘর। কোনটি শিবির প্রধানের: কোনটি গুদাম। এসবে থাকেন বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত পরিচালকবৃন্দ।

 সুপারভাইজার হান্নান সাহেব গোড়া থেকে অংশ্লিষ্ট। তিনি প্রথম শিবিরটি চালু করেন। শিবির প্রধান আফজাল খান আনেন আগস্টের মাঝামাঝি। তিনি কুমিল্লার সুপরিচিত ছাত্রনেতা। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন ইমাম আবু জাহিদ সেলিম। আমি এসে পেলাম। আমার এক পুরনো সহপাহীকে- খায়রুল আলম শিবিরের প্রধান আকর্ষণ তরুন মুক্তিফৌজেরা। প্রতিদিন এরা আসছে। আর নাম লিখাচ্ছে তে। কেউ আসে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে কেউ আসে ঢাকা-ফরিদপুরের মতো দূরের এলাকা থেকে। এদের মধ্যে পনের বছরের কিশোর আছে। আবার পয়ত্রিশের যুবকও নজরে পড়ে।

 হাতিমারা একটি যুবশিবির। দেশত্যাগী তরুণরা প্রথমত এসবে আশ্রয় নেয় ও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে। রাইফেল, স্টেনপান ও গ্রেনেড ছোড়া অম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দেয়া শরীরকে কুষ্টসহিষ্ণু করে সামরিক শিক্ষার