পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৯৭

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড

 মুজিবভক্তদের জন্যে। স্বাধীনতার পর মুজিব-রাজত্ব নিরঙ্কুশ করার কাজে এদের ব্যবহার করা হবে। আপনি যেহেতু ভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী; সেজন্যে আপনার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দেরাদুন যেতে পারলেও; কোনভাবে আপনার মতিগতি জানতে পারলে পরিণতি বিপদজ্জনক হবে। সুতরাং এখানে আছেন ভাল। চুপচাপ থাকেন ও সময় কাটান।

 কিন্তু সময় আর কাটেনা। ঠিক করলাম একবার বাড়িতে যাব। ক’দনি ধরে শুনছিলাম; এই শিবির পার্বত্য ত্রিপুরার আরো ভেতরে সরিয়ে নেয়া হবে। তাহলে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সেজন্য একদিন সকালবেলা রওয়ানা হলাম দেশের দিকে।

 বারোটার দিকে বাংলাদেশের ভেতর ঢুকলাম। গ্রামের পর গ্রাম নির্জন; পরিত্যক্ত। উঠোনে ঘাস গজিয়েছে, বাইরের উনুনগুলো ভেঙে পড়েছে। কলাগাছে পাকা কলা, খাবার লোক নেই। একটি বাড়িতে ডাব গাছ দেখে প্রবল তৃষ্ণা পেল। আমার সঙ্গী ছিল আমাদের পাশের বাড়ির রহিম। সে গাছে ওঠার উপক্রম করতে বাড়ির ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলেন এক শীর্ণকায় বৃদ্ধ। তিনি ঘর থেকে ডাব ও বঁটি এনে দিলেন। পরিতৃপ্তি সহকারে তৃষ্ণা নিবারণ করে আমরা যাত্রা করলাম। আছরের নামাজের সময় বাড়িতে পৌঁছলাম। মা তাড়াতাড়ি ভাত বেড়ে দিলেন, আমি গেলাম পুকুরঘাটে গোছল করতে। হঠাৎ চীৎকার উঠল মিলিটারী আসছে। ফকিরহাট ঘাঁটি থেকে রওনা দিয়ে তারা আমাদের গ্রামে এসে গেছে। দিলাম দৌড় পশ্চিম দিকে-মাঠ পেরিয়ে রেল লাইন অতিক্রম করে যেতে পারলে জানে বাঁচা যাবে। মাঠে পৌছে দেখলাম মাঠভর্তি লোক। সবাই দিগ্বিদিকে ছুটছে। বালক-বালিকা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নারী পুরুষ সবাই ছুটছে। আমার সাত বছরের ছোট বোন নুরুন্নাহারও কাপড়ের একটি পুঁটুলি নিয়ে মা ও চাচীদের পেছনে দৌড়ুচ্ছে।

 মাইল দুয়েক দৌড়ুনোর পর আপাতত নিরাপদ স্থানে পৌছা গেল। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ক্ষুধায় ও পরিশ্রমে এত অবসন্ন ছিলাম যে ধান ক্ষেতের আলের ওপর শুয়ে পড়লাম। অনেক পরে, রাতের অন্ধকারে সন্তপর্ণে ফিরলাম বাড়িতে। তার দুদিন পা আবার হাতিমারা।

 সম্ভবত আগস্ট মাসের শেষাশেষি শিবির সরিয়ে নেওয়া হয় পদ্মানগরে— আরো পনের বিশ মাইল অভ্যান্তরে। পূর্বোল্লিখিত বক্রনগর ক্যাম্পও একই জায়গায় নিয়ে আসা হয়। ইতিমেধ্যে আমি ট্রেনিং-এর আশা ছেড়ে দেয়েছিলাম; সুতরাং কর্তৃপক্ষ আমাকে political Motivator হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেন। প্রতি সপ্তাহে আমাকে একটি করে বক্তৃতা দেয়ার কথা বলা হল—উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিকভাবে দীক্ষিত করা। এ কাজ করার জন্যে আমি ছোট একটি গ্রন্থাগার তৈরি করলাম এবং নিজেও পড়াশোনায় মন দিলাম। শিবিরের বাইরে একটি স্থান নির্বাচন করে নিলাম প্রায় দুপুর কাটত সেখানে। বক্তৃতায় আমি বললাম মুক্তির কথা—‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’— ঐ কথার উল্লেখ করে। ছেলেরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে শুনত। কোন কোনদিন হয়ত বলতাম সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবের কথা— চারু মজুমদারের ও চে গুয়েভারার রণকৌশলও আলোচনায় আসত। সমাজতন্ত্র মানে, ইতিহাসের বিকাশ, শোষণ-মুক্ত প্রভৃতি সরল ভাষায় বলার চেষ্টা করতাম।

 সেপ্টেম্বর মাসে বাড়ির দুটো দুঃসংবাদ পাই। আমাদের গ্রামটি পুড়িয়ে দিয়েছে মিলিটারীরা, বিশেষ করে পুড়িয়েছে চাচার বছরখানেক আগে নির্মিত সুদৃশ্য বাড়িটি। আমাদের ঘরগুলো অধিকাংশ পুড়ে গেছেএকটি ঘর শুধু রক্ষা পেয়েছে। জ্ঞাতি ভাই ফজলু ও নুরুদের সব ভস্মীভূত হয়ে গেছে। (এরা মুক্তিযোদ্ধা ছিল) দ্বিতীয়টি হল যে আব্বাকে, চাচাকে ও চাচাতো ভাইদের ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। প্রচুর নির্যাতন করেছে; তবে কেন জানি না প্রাণে মারেনি। আমাদের বাড়ির লোকেরা অন্যত্র কোথাও আশ্রয় নিয়েছে।

 অক্টোবর মাস থেকে ভাল খবর পেতে লাগলাম। বাড়ি থেকেও সুসংবাদ পেলাম। ফকিরহাটের ঘাঁটি ছেড়ে পাকিস্তানী বাহিনী চলে গেছে। গাঁয়ের সবাই বাড়িতে ফিরেছে। যুদ্ধেরও নাটকীয় মোড় ফেরা লক্ষণীয় হয়ে