পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০০

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড

২৫শে মার্চের কালো রাত্রির পর যখন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলাম তখন সিদ্ধান্ত নিলাম সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য নিজের শক্তি অনুযায়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিব।

 বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা ছেড়ে কিছু দিন বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকার পর যখন দেখলাম আশ্রয়দানকারীর সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে তখন একদিন নরসিংদীর পথে ভারত সীমান্তের দিকে রওয়ানা হই। ৪ঠা এপ্রিল কি ছিল সেদিনটি? তিতাসের ওপারে এক মেঘাচ্ছন্ন সকালে যখন আমি পরিবারসহ সিংগারবিল যাওয়ার পথ খুঁজছি দৈবক্রমে আমার এক প্রাক্তন ছাত্র আমাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে কবি সানাউল হকের বাংলোয় নিয়ে আশ্রয় দেয়। এবং নদীর ওপারে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ওপর যেদিন পাকিস্তানী প্লেন থেকে কয়েক দফা গুলি বর্ষিত হয় সেদিন সন্ধ্যায় স্ত্রী এবং চার পুত্র কন্যা সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলার দিকে রওয়ানা হই। সম্ভবতঃ সেদিনটি ছিল ১৪ই এপ্রিল।

 ভারতে অবস্থানকালে আমার তৎপরতাকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ (১) পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যের দায়িত্ব পালন; (২) অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে নানা সমাবেশ এবং সেমিনারে বাংলাদেশ আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা; (৩) বাংলাদেশ শিক্ষা সমিতির প্রথমে আহবায়ক; পরে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে প্রয়োজনমত মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে সমিতির স্বতন্ত্র কার্যক্রমে অংশগ্রহন। এছাড়াও এই সময়ে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের কোন কোন বক্তৃতা ও নীতিবষিয়ক প্রতিবেদনের খসড়া ইংরেজিতে তৈরি করে দিয়েছি বা প্রয়োজনমতো বাংলায় করতেন ডক্টর আনিসুজ্জামান।

 বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি এবং তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমার কয়েকটি জায়গায় কিছু স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এখানে তা উল্লেখ করব। আসামের বুদ্ধিজীবীো “স্বাধীন বাংলাদেশের তাৎপর্য” বিষয়ে শিলং সরকারী কলেজের মিলনায়তনে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন আসাম সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শ্রী ত্রিপাঠী। আমি সে উপলক্ষে যা বলেছিলাম তা’ সংক্ষেপে এই: উপমাহাদেশের দুটি দেশ; ভারত এবং বাংলাদেশ; খুব স্বাভাবিক কারণে পরস্পরের বন্ধু হবে। ভারত বিভক্ত হওয়ার পর ইতিহাস; সংস্কৃতি ও ভূগোলের দিক দিয়ে যথেষ্ট নৈকট্য সত্বেও ভারত এবং পাকিস্তান স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও সমরবাদীর ভারত বিদ্ধেষকে তাদের স্বৈরশাসন এবং অর্থনৈতিক শোষণের স্বার্থে জিইয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার পর নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট এবং ভারতের মধ্যেকার সম্পর্কের ভিত্তি হবে পরিণত কাণ্ডজ্ঞান প্রবুদ্ধ স্বার্থচেতনা এবং পারস্পরিক সম্ভন্ত এবং এই প্রক্রিয়ার ইতিহাসের একটি বড়রকমের বিকৃতি দূর হবে। দু দেশের যৌথ নদনদী। সহজ যাতায়াতের প্রয়োজন অর্থনৈতিক আদান প্রদান ও সহযোগিতার প্রশ্নাতীত যৌক্তিকতারও তাই দাবি করে। বাংলার সশস্ত্র সংগ্রামে ভারতের সহায়তা আমাদের বিপুলসংখ্যাক শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয় দান; একটি বড় গণতান্ত্রিক দেশের অন্য একটি গতন্ত্রকামী মানবগোষ্ঠীর প্রতি এ মহানুভব সমর্থন। এই নতুন সম্পর্কের শুভসূচনা। শুধু একটি কথা ভারত আয়তনে; সম্পদে; শক্তিতে একটি বড় দেশ আর বাংলাদেশ সেসব দিক থেকে ক্ষুদ্র। এ অসমতা যেন দু’দেশের স্বাভাবিক বন্ধুতার পথে কোনদিনও অন্তরায় সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে দু’দেশকে সজাগ থাকতে হবে। বক্তৃতা শেষ হলে মন্ত্রী মহোদয় আসন ছেড়ে এসে আমায় অভিন্দন জানিয়ে আমার করমর্দন করেন এবং আমার শ্রোতৃবৃন্দও আমার বক্তব্য ও তার আন্তরিকতা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন এক আজব কাণ্ড করে বসে। তারা তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো রিপোর্টে দাবি করে যে বাংলাদেশ থেকে আগত এক নরাধম অধ্যাপক ভারতকে সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে হাঙ্গেরী রুপে কল্পনা করে ভারতকে একটি প্রতিবেশী দমনেচ্ছু আগ্রহী শক্তিরুপে চিত্রিত করেছে। পশ্চিম বঙ্গের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যাক্তি যাঁরা আমাকে জানতেন; আশ্রয়দানকারী সরকারের বিরাগ থেকে সে যাত্রা আমায় রক্ষা করেন।

 আরেকটি অন্য ধরনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল অন্ধ্র প্রদেশের এক দরিদ্র মুসলিম পল্লীতে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে। এই স্বল্প শিক্ষিত গরীব মুসলমানদের কাছে পাকিস্তান ছিল