পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০১

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড

একটা বিশ্বাস এবং কল্পনার স্বর্গ; তারা সেখানে কোনদিন যেতে পারবে না; তবুও যে স্থানটি তাদের মনের মধ্যে লুকোন একটি আশ্বাস ও নিরাপত্তা। অনেকক্ষণ বক্তৃতার পরও দেখলাম মানুষগুলো পাহাড়ের মত নীরব নিরুত্তাপ, তাদের চোখে শীতল ক্রোধের কাঠিন্য। কিন্তু এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল যখন আমি তাদের দিকে সঙ্গীনের মত কয়েকটি প্রশ্ন উদ্যত করলাম এবং জানতে চাইলাম ইসলামের কোন নির্দেশ আছে ধর্মের নামে কোনও মুসলমান সৈনিক পিতার সামনে কন্যাকে ধর্ষণ করতে পারে, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী ও শিশু হত্যা করতে পারে? প্রশ্নের পর পাকিস্তানী বর্বরতার কিছু বর্ণনা, তারপর আবার প্রশ্ন করলাম, এরই নাম কি ইসলাম? এই পাকিস্তানই কি আপনার প্রিয় পাকিস্তান? ‘না’ ভঙ্গিতে অনেকগুলো হাত এক সংগে উঠে গেল। আমার সে সন্ধ্যার বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই পাথর গলেছিল; সেই সরল বিশ্বাসী মুসলমানরা বুঝেছিল; কেন বাঙ্গালীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল।

 স্বাধীনতাযুদ্ধের সপক্ষে কার্যক্ষেত্রে মুজিব নগর সরকারের সংগে আমার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল এবং সরকারসংশ্লিষ্ট তৎপরতার বাইরেও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। শুধু একটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করেছি- সেটা হল সংবাদমাধ্যমের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের সংগে সহযোগিতা।

 বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তি যাঁদেরকে বুদ্ধিজীবী বলেও আখ্যায়িত করা হয়, ভারতে অবস্থানকালে বাংলাদেশ আন্দলোনভিত্তিক তাদের একটা আলাদা অস্তিত্ব বা তাঁদের মধ্যে স্বতন্ত্র রকম সংহতি ছিল বৈকি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি স্বতন্ত্র সংহতির একটি দৃষ্টান্ত।

 দিল্লী আন্তর্জাতিক সেমিনারে পাঠ করার জন্য The Nature of Bengali Nationalism শিরোনামে আমাকে একটি paper তৈরি করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল, তবে সে সেমিনারে আমি যোগ দিতে অসমর্থ হই। কিন্তু প্রবন্ধটির জন্য যে কাজ শুরু করেছিলাম তা’ বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি অনুমোদিত একটি গবেষণা প্রকল্পের রুপ নেয়। Perspectives on Bengal শিরোনামে রচিত এই গবেষণা প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও উৎস নিরুপণ করা।

 মুজিব নগর সরকার একটি পরিকল্পনা কশিন গঠন করেছিলেন। একটি Long Term একটি Mid term এবং Short term প্ল্যান তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এই কমিশন কে। আমি এই কমিশনের একজন। সদস্য ছিলাম। কোন Long term বা mid term প্ল্যান নিয়ে কমিশন সদস্যদের মধ্যে কোনও গভীর বা ধারাবাহিক আলোচনা বা বিতর্ক হয়নি। তবে কিছু Short term প্ল্যান নিয়ে মত বিনিময় হয়েছেযেমন যুদ্ধশেষে বিধ্বস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন বিষয়টি এবং এর কোনও কোনওটি নীতিগতভাবে গৃহীত হয়েছিল। (মনে পড়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন সমস্যা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি সমীক্ষা আমার তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছিল)। অস্থায়ী সরকার আওয়ামী লীগের পুরো আদর্শগত বর্ণালীর ধারক হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই যদ্ধ জয়ের শেষে এক কোটি শরণার্থীসহ গৃহে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। তার কাছ থেকে কোন দীর্ঘমেয়াদী, এমনকি মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরীর ভিত্তিগত দিকনির্দেশ পাওয়া সম্ভব ছিল না। কার্যতঃ তা পাওয়াও যায়নি। মৌলিক বিষয়ে, আমার বিশ্বাস, কমিশনের সদস্যরাও একমত পোষণ করতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক হবে এমন একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত ছিল কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র ও মিশ্র অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে সে সমাজতন্ত্র সীমাবদ্ধ থাকবে, না ভূমির ব্যক্তি মালিকানা বাতিল বা পুনর্বণ্টনের পথে আরও সুদূরগামী হবে, এ জাতীয় প্রশ্নের মীমাংসা আমাদের যুদ্ধরত অস্থায়ী সরকার দেননি। সুতরাং কতকগুলো অবিতর্কমূলক স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনাতে কমিশন নিজের কাজকে সীমাবদ্ধ রেখেছে। তার অর্থ এই নয় যে আলাদাভাবে কমিশনের সদস্যরা কোনও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার রুপরেখা বিবেচনা করেননি-কিন্তু তা সহজবোধ্য কারণেই সরকারের দরবার পর্যন্ত পৌঁছেনি।