পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০৬

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড

ঘটবে সকালেই তার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বিভিন্ন লোক, শিক্ষক এবং ছাত্র যূথবদ্ধ হয়ে নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কথাবার্তা চলছে। আশা এবং আশাঙ্কা এ উয়ের মিলন ঘটলে যে এক রহস্যময়তার সৃষ্টি হয় তখনকার সময়ে সেই রহস্যময়তা ছড়িয়ে ছিল। শুনলাম পরের দিন ২৪ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র এবং শিক্ষক সম্মিলিতভাবে একটি সভা আহ্বান করেছে যে সভায় ছাত্ররা স্বাধীন বাংল দেশর পতাকা উত্তোলন করবে।

 পরের দিন বিকেলে শহরে মিটিং ছিল আমরা সবাই সেখানে গেলাম। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হল। বক্তৃতা করেলেন অনেকে। সভা চলাকালে হঠাৎ খবর এলো সমুদ্র বন্দরে পাকিস্তান থেকে আগত জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামানো হচ্ছে এবং বাঙ্গালী শ্রমিকদের সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাদের সংঘর্ষ বেধেছে। আমরা খবর পেলাম যে জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামাতে আপত্তি করায় বাঙ্গালী শ্রমিকদের উপর গুলি চলানো হয়েছে এবং অনেক নিরীহ লোক নিহত হয়েছে। মাঝপথে আমাদের সভা ভেঙ্গ গেল। আমার ছোট মেয়ে এবং জামাতা দেব পাহড়ে থাকত।আমি গাড়ী নিয়ে সেখানে গেলাম এবং তাদেরকে আমার সঙ্গে ক্যাম্পাসে নিয়ে এলাম। দুর্ঘটনা একটা ঘটবে এটা আমরা সকলে অনুমান করেছিলাম। এই দুর্ঘটনার মুহূর্তে আমি আমার ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাইনি। সবাইকে তাই একত্রিত করেছিলাম। বড় মেয়েকে তো আগের দিনই ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিলাম। পরের দিন ছোট মেয়েকে। যাহোক সেদিন শহর থেকে বিশ্ববিদ্যলয় ক্যাম্পাস ফেরা খুব সহজ হয়নি। আমাদের যাবার পথে ক্যাণ্টনমেণ্ট পড়ে। সেসব রাস্তায় চলাচল বন্ধ ছিল। বড় বড় গাছ কেটে এবং আড়াআড়িভাবে কিছু ট্রাক সাজিয়ে রাস্তার চলাচল কে বিঘ্নিত করা হয়েছে। আমরা বাধ্য হয়ে গ্রামের কাঁচা মাটি এবং খোয়া ফেলানো পথ দিয়ে অনেক সময় নিয়ে রাত প্রায় ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে ফিরলাম। রাত্রিবেলা গ্রামের পথ দিয়েই গিয়েছিলাম। সুতরাং আশেপাশের জঙ্গল এবং বন্যফুলের সমারোহ চোখে পড়েনি কিন্তু তাদের গন্ধ পেয়েছিলাম। একজন ইংরেজ কবি এরকম বর্ণনা করেছেন এভাবে, শংকিত পথে অন্ধকারে ফুলগুলো কোন আশ্বাস আনেনা তাদের সুগন্ধ ক্রমশঃ হারিয়ে যায় পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে।

 পঁচিশ তারিখ সারাদিন মানুষের আনাগোনা চলছিল বিভিন্ন এলাকায়। শহর থেকে রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ এসেছিলেন, সন্ধ্যার দিকে ইষ্ট বেঙ্গল রাইফেলস এর একটি প্লাটুন বর্ডারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নিল। গ্রমের লোকেরা এদের জন্য প্রচুর খাবারের ব্যবস্থা করল। তখন আমাদের সকালের মধ্যে একটি মাত্র বিশ্বাস সমুচ্চারিত যে আমরা বাংলা ভাষাভাষি এক ও অভিন্ন। যারা বাংলায় কথা বলে তাদের সকলেই এখন একত্রিত হবে একটি বিশ্বাসের সচলতায় যে এদেশ আমার। আমার মনে হয় তখন এই বিশ্বাসটি নির্মাণ করতে হয়নি, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবেগের অন্তঃসার হিসাবে উৎসারিত হয়েছে। আমরা তখন চিন্তা করেছিলাম না ভবিষ্যৎ আমাদের কি হবে। আমরা একটি প্রবল আন্তরিক ভাবাগের প্রবাহকে আশ্রয় করেছিলাম। সারাদিন বিভিন্ন সময় আমরা ঢাকার সঙ্গে করছি। যোগাযোগের স্থান ছিল দুটো ইত্তেফাক অফিস ও বঙ্গবন্ধুর বাড়ী। কিন্তু সন্ধ্যার একটু পরে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখনই ভয় হয়। কিছু একটা ভয়ানক ঘটতে যাচ্ছে এটা অনুভব করছিলাম কিন্তু তা যে কত ভয়াবহ এবং প্রচণ্ড হতে পারে তা আমাদের অনুমান করার সাধ্য ছিল না। বিপদের নম্ভাবনা আমরা ব্যাখ্যা করি ঝড় আসবে বলে। এদেশে আমরা প্রকৃতির তাণ্ডবকে তাই প্রকৃতির উপমা আনি। আমরা বলি ঝড় আসবে, প্রচণ্ড ঝড়, প্রকাণ্ড সব বৃক্ষ উৎপাটিত হবে, লোকেরা ধুলায় আচ্ছাদিত হবে, বন্যায় গৃহাঞ্চল প্লাবিত হবে। আমরা প্রকৃতির উপমা একারণেই দেই যে প্রকৃতির তাণ্ডবের মুখে মানুষ সম্পূর্ণ অসহায়। সে বিপদ কে রোধ করতে পারে না। সে ভেসে যায় এবং ধ্বংসের লীলা নৈপুণ্যে সে নিশ্চিহ্ন হয়। আমার এক বিদেশী বন্ধু সবসময় বিপর্যয়ের সঙ্গে পাহাড় ভেঙ্গে পড়ার উপমা দিতেন। তিনি ছিলেন জার্মান, হাইডেলবার্গের লোক, চতুর্দিকে সবসময় পাহাড় দেখতেন তাই পাহাড়ের কথাটি তার অনিবার্যভাবে মনে পড়ত। তিনি বলতেন, পাহাড় যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন প্রস্তর খণ্ডগুলো প্রচণ্ড বেগে নিম্নাভিমুখে ছুটতে থাকে। তার গতিরোধ করার সাধ্য কারো থাকে না। পাথরগুলো প্রচণ্ড গতিতে সম্মুখের সমস্ত কিছুকে নিশ্চিহ্ন করে ছুটে চলে, ধ্বংসের অনিবার্যতা তো একেই বলে।