পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০৭

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড

 ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমরা প্রায় সারা রাত জেগেই কাটিয়েছিলাম। রাত ১টা পর্যন্ত আমরা বিভিন্নজনের বাড়ীতে বসে আলাপ-আলোচনা করেছি কর্তব্য নির্ধারণের জন্য। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে কিছুই নির্ধারণ করতে পারিনি। একটি প্রধান চিন্তা ছিল ক্যাম্পাসে অবস্থানরত বিভিন্ন পরিবার কে কিভাবে রক্ষা করা যায়। এখানে তো সম্ভাব্য ভয়াবহতার চিত্র উদঘাটিত হয়নি। তাই আমরা দ্রুত রাত্রির অবসান চাচ্ছিলাম এবং দিনের আলোয় কর্তব্যের কথা চিন্তা করব ভেবেছিলাম। সেসময়, রুপক করে বলা যায়, আমাদের দক্ষিণ দিকে নিস্তব্ধতা, বাম দিকে নিস্তব্ধতা, আমাদের সম্মুখ ও পশ্চাতে নিস্তব্ধতা। শুধু আমাদের মাথার উপরে আকাশে বাংলা বর্ণমালারা সবকটি অক্ষর ছড়িয়ে আছে। সেখান থেকেই বেদনা এবং প্রতিবাদের শব্দগুলো সংগ্রহ করতে হবে।

 রাত্রি কাটালো সুগভীর নিদ্রায় নয়, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায়। প্রায়ই জেগে উঠেছি আশংকায় এবং বিমূঢ়তায়। সকালে শয্যা ছেড়ে মাঠে কবুতরের খাঁচার দিকে এগিয়ে গেলাম। এটা আমার রোজকার অভ্যাস। খাঁচার দরজা খুলে গম অথবা ধান মাঠে ছিটিয়ে দেই। কবুতর গুলো প্রচুর পবিত্র শুভ্রতায় শেফালী ফুলের মতো খাদ্য কণার উপর ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। কবুতরের ঘরের দরোজা খুলে দিয়ে মাঠের মধ্যে ধান ছড়িয়ে আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম কিন্তু কবুতরগুলো খাবারের দিকে এগিয়ে এল না। ওরা খাঁচার সামনে একটু ঘুরে ওদের ঘরের ছাদের ওপর বসলো। ১২টির মত কবুতর ছিল, সব কটি প্রায় সাদা, একটি দুটি খয়েরি রঙের। হঠাৎ কবুতর কটি একসঙ্গে উড়তে লাগলো। পাখা ঝাপটিয়ে প্রথম একটি উড়লো, পরে দোতলা বাড়ীর ছাদ পর্যন্ত উড়লো। পরে সব কটি পাহাড়ের মধ্যে ক্রমশঃ সম্পূর্ণ হারিয়ে গেল। আমি আমার জীবন এ রকম দৃশ্য কখনো দেখিনি। সে মুহূর্তে আমি জানলাম যে, ঢাকায় ভয়ানক কিছু ঘটেছে এবং আমাদের জীবনেও আমরা একটি সংকটের সম্মুখীন হচ্ছি।

 চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকে প্রায় লাগোয়া ছিল ক্যাণ্টনমেণ্ট। আমরা রোজই দেখতাম যে হেলিকপ্টার উড়ে ক্যাণ্টনমেণ্টে যাচ্ছে। এবংযাবার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বার কয়েক ঘুরে যাচ্ছে। তাছাড়া কুমিরার দিকে থেকে পাকিস্তানী সৈন্য চলাচলের সংবাদ ও পাওয়া যাচ্ছিল। যদিও প্রথমে কয়েকদিন চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তান সেনাবাহিনী কবলিত হয়নি এবং মেজর জিয়া নামক একজন সৈনিকের নাম তখন আমরা শুনেছিলাম যিনি কালুরঘাটে ঘাঁটি স্থাপন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করছিলেন। কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ষ্টেশন থেকে জিয়ার কণ্ঠে আমরা স্বাধীনতার ঘোষণাবাণী শুনতে পেয়েছিলাম। সেই মুহূর্তটি আমাদের জীবনের আশা এবং উদ্দীপনার একটি তীব্রতম মুহুর্ত ছিল। যখন চতুর্দিকে বিশৃঙ্খলা এবং সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের অভাব ঠিক সেই মুহূর্তে জিয়ার কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণার দাবী একটি বিস্ময়কর মানসিকতার সৃষ্টি করেছিল। আমরা তখনই ভাবতে পেরেছিলাম যে, কোন কিছুই হারিয়ে যায়নি, আবার সবকিছু ফিরে পাবার সম্ভাবনা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনবরত মানুষের আনাগোনা হচ্ছিল। উপাচার্য ডং মল্লিককে কেন্দ্র করে একটি প্রতিরোধের ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের বাসগৃহগুলে কে অরক্ষিত রেখেই ৩০শে মার্চ সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে। কুণ্ডেশ্বরী রাউজান থানার অন্তর্গত। কুণ্ডেশ্বরীর মালিক বাবু নতুন চন্দ্র সিংহ আমাদের সবার জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে আনন্দিত হয়েছিল। কুণ্ডেশ্বরী বিদ্যালয়টি একেবারেই বড় সড়কের পাশে সম্পূর্ণ অরক্ষিত। রাত্রি বেলা প্রায়ই নানাবিধ শঙ্কায় আমাদের জেগে উঠতে হত। এদিকে-ওদিকে সৈন্য চলাচলের সংবাদ শুনতাম। কখনো বিদ্যালয় গৃহটি আক্রান্ত হবে এমন আশঙ্কার খবরও আসতো। শেষ পর্যন্ত সকলের পরামর্শে আমরা কুণ্ডেশ্বরী পরিত্যাগ করে প্রথমে নাজিরহাট এবং পরে কাটাখালি হয়ে রামগড়ে উপস্থিত হলাম। আমরা কুণ্ডেশ্বরী ছাড়লাম ৭ই এপ্রিল তারিখে। সে সময় একটি সিদ্ধান্তে আমাদের আসতে হয়েছিল। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম কোন গ্রামে আত্মগোপন করে থাকব কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিবেচনা করা হয় যে সীমান্ত এলাকায় যাওয়াই ভাল। কেননা সেনাবাহিনী আমাদের পশ্চাদ্ধাবন করছে এবং গ্রামাঞ্চলে গিয়েও আমরা রক্ষা পাব না। কিন্তু সীমান্তে যদি যাই তাহলে প্রয়োজনবোধে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভবপর। রামগড় তখন মেজর জিয়ার প্রতিরোধ কেন্দ্র ছিল। তিনি কালুরঘাট থেকে সরে এসে রামগড়ে অবস্থান নিয়েছিলাম। রামগড়ে