পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০৮

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড

পৌঁছে জিয়াকে প্রথম চাক্ষুষ দেখলাম। তাঁর চোখে কালো চশমা ছিল এবং মুখ ছিল শ্মশ্রুমণ্ডিত। তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিলেন এবং কখনো কখনো কাউকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন। আমাদের কারো সঙ্গেই তিনি বিশেষ কোন কথা বলেননি।

 পহেলা বৈশাখ তারিখে আমরা সীমান্ত অতিক্রম করার নির্দেশ পেলাম। জিয়াউর রহমান আমাদের জানালেন যে, কোন সিভিলিয়ানের তখন আর রামগড় থাকা নিরাপদ নয়। কেননা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তান বাহিনী সেখানে এসে পড়বে। আমাদের পরিবার পরিজনদের জন্য বাসের ব্যবস্থা করে আমি, ডঃ মল্লিক, তৌফিক ইমাম এবং আরো কয়েকজন রামগড়ের সীমানা পেরিয়ে আমরা আগরতলার দিকে রওয়ানা হলাম। এ সময়কার একটি উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, সাবরুমের রাস্তায় একদল ভারতীয় স্কুলের ছাত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ। ছাত্ররা আমাদের জীপ থামিয়ে জীপের চারদিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গান করতে লাগল, “আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে”। সিকান্দার আবু জাফর এই গানটি লিখেছিলেন কিছুদিন আগে তখন এই গানটি তাৎপর্য বুঝতে পারিনি। কিন্তু অপরিচিত পরিমণ্ডলে শঙ্কিত সময়ের পদক্ষেপে গানটির বাণী আমার কাছে অসাধরণ তাৎপর্যবহ মনে হলো। আমার মনে হলো ঠিক এমন করে হৃদয়ের সর্বস্ব দিয়ে কেউ হয়ত তার জাতির বেদনাকে রুপ দিতে পারেননি। সে মুহূর্তে ইমোশন প্রবল ছিল। তাই হয়ত গানটিকে অসাধারণ মনে হয়েছিল। তবে অসাধারণ তো বটেই তার কারণ, আমাদের সংকটের মুহূর্তে এ গানটি আমদের জন্য সমর্থন ও সহয়তা এনেছিল। আগরতলায় আমাদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি এবং মাহবুব আলম চাষী আগরতলায় একটি বাংলাদেশ মিশন খুলছিলেন। আমাদের পরিজনবর্গ আগরতলায় এসে পৌঁছোয় বিকেলবেলা। প্রথম রাতের জন্য আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম আগরতলায় গ্রাণ্ড হোটেলে। নামটি গ্রাণ্ড কিন্তু কর্ম ব্যবস্থা অত্যন্ত সাধারণ এবং মলিন। হোটলটি ছিল আগরতলায় রাজপরিবারের। সে রাতেই আমাদের সংগে দেখা করেন মওদুদ আহমদ এবং সাদেক খান। একটু বেশী রাতে এম আর সিদ্দিকী সাহেব ও হোটেলে এলেন এবং পরের দিন তিনি কলকাতায় যাবেন বললেন। আমাদের প্রস্তুত থাকতে বললেন। অমেরা এক রাতই গ্রাও হোটেলে ছিলাম। পরের দিন আগরতলায় সরকার নরসিংগড়ে একটি পলিটেকনিক স্কুলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।

 আগর তলায় আমরা অবর্ণনীয় অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের অধিকাংশের কাছে বিশেষ টাকা পয়সা ছিল না। পাকিস্তানী মুদ্রার বিনিময়ে হার দাঁড়িয়েছিল ১০০ টাকার স্থলে ভারতীয় ৪০ টাকা। অন্ততপক্ষে পোদ্দারদের কাছ থেকে আমরা এ হারই পাচ্ছিলাম। সে সময় আমার চিন্তা হল কি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ, যাঁরা দেশত্যাগ করে আসতে বাধ্য হয়েছেন, এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবী, তাঁদের জন্য অর্থনৈতিক সংগতির কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা। প্যারিসে আমার কিছু পরিচয়ের সূত্র ছিল। একাডেমী ফ্রাঁন্স- এর সদস্য এবং বিখ্যাত ফরাসী বুদ্ধিজীবী এবং কবি পীয়ের ইমানুয়েলকে আমি চিনতাম। তাঁর কাছে আমি একটি দীর্ঘ পত্র লিখি। আমার চিঠি পীয়ের ইমানুয়েল পান ১৭মে তারিখ। ১৯ মে তারিখে ইমানুয়েলের পক্ষ থেকে একখানা টেলিগ্রাম পাই। টেলিগ্রামের ভাষা ছিল নিম্নরুপঃ “পীয়ের ইমানুয়েল আপনার চিঠি পেয়েছে। চিঠির অংশবিশেষ প্যারিসের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশের অনুমতি চাচ্ছি। আশা করি ভবিষ্যতে অবস্থার উন্নতি ঘটবে”। পরবর্তী চিঠিতে প্যারিস থেকে ষ্টিফেন স্পেনডারের ঠিকানা আমার কাছে পাঠানো হয়। তখন তিনি কানেকটিকাটে ইংরেজী বিভাগে অধ্যাপনা করেছিলেন। বিখ্যাত স্পেনীয় দার্শনিক সালভাদর মাদারিয়গার ঠিকানাও আমি এভাবে পাই। এদের দু’জনের কাছে ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমি চিঠি লিখি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে তাদের সহানুভূতি কামনা করি। পীয়ের ইমানুয়েল বিভিন্ন সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের জন্য আবেদন জানান। অবশেষে International Association for cultural freedom এর সভাপতি মিং শেফার্ড ষ্টোন আমাকে জানান যে ফোর্ড ফাউণ্ডেশন আমাদের সাহায্যের জন্য পঁচিশ হাজার ডলার অনুমোদন করেছে। এ টাকা “The writers, scholars, and Intellectuals who have forced out of their land into India “ তাদের জন্য ব্যয় করতে হবে।