পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩১৪

ভবনে একতলার অধিবাসী মুকতাতিদরের মৃতদেহ। কর্কশ কণ্ঠে নির্দেশ এল এলাকাবাসীদের প্রতি- অবিলম্বে কালপতাকা আর বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে ফেলার। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম জনৈক সৈনিক আমাদের ভবন শীর্ষ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। ভবনটি কেঁপে উঠল। মনে পড়ে গেল আমাদের ভবন শীর্ষেও বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে, ছেলেরা ২৩ মার্চ তারিখে উত্তোলন করেছিল আর নামায়নি। অতি সন্তর্পণে মিলিটারীর চক্ষু এড়িয়ে ছাদে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে পতাকাকে ধীরে নামিয়ে আনলাম। মুহুর্তে চিত্ত বেদনায় উদ্বেলিত হয়েছিল। ভেবেছিলাম এই পতাকা কি আবার কোনদিন তুলতে পারব।

 দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডঃ মুর্তজাকে দিয়ে ও আরও কয়েকজনকে দিয়ে আমাদের ভবনের দিকে এল। আতঙ্কে অপেক্ষা করছিলাম যে কোন মুহুর্তে মৃত্যুদূতের আগমন। নীচের তলায় লোকজন ছিল না কিছুক্ষণ দরজায় লাথি মারল, সৌভাগ্য ওরা চারতলা পর্যন্ত উঠে এল না। একটু পরে লাশগুলি নিয়ে আমাদের উদ্দেশে পুনর্বার সাবধানবাণী উচ্চারণ করে ওরা স্থান ত্যাগ করল। আমরা বাঁচলাম।

 রেডিওতে ঘোষিত হল, অবাঙালী কণ্ঠে, কর্কশ আর ভাংগা বাংলায়, সারাদেশ কঠোরভাবে সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হয়েছে, রাস্তায় বা ঘরের বাইরে দেখা মাত্র গুলি করা হবে। পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী প্রতিরোধ আন্দোলনকে ভেংগে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ম্লান মুখে সহধর্মিণী পাশে এসে দাঁড়াল। উদ্বেগ ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করল ‘বঙ্গবন্ধুর’ খবর কি? কি জবাব দেব! আমি ও ভাঁবছিলাম তার কথা। পেরেছেন কি নিজেকে বাঁচাতে? নিরাপদ স্থানে সরে গিয়েছেন কি! ভাবছিলাম অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কথা, ছাত্র নেতাদের কথা। পরে সন্ধ্যায় শুনলাম পাকিস্তানের প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার রেডিও ভাষণ- সমগ্র পরিস্থিতির জন্য বাংগালী, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করে কুৎসিৎ ও অশালীণ ভাষায় আক্রমণ করলে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে স্বয়ংসিদ্ধ প্রেসিডেণ্ট কর্কশ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, “The man and his party are cncmics of Pakistan IIc had attacked the solidarity and integrity of Pakistan this crime will not go unpunished.” সেই কণ্ঠ এতদিন পরে আজ ও আমার কর্ণে ধ্বনিত হয়।

 এত নিরাশার মধ্যেও আশার আলোর ঝলকানি বয়ে আনল ‘আকাশবাণী’- ভেসে এল রেডিও তরংগে মধুর আশ্বাসবাণী “সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”। আকাশবাণী জানাল পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার আশেপাশে, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, য়শোর, চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে বাঙালী মুক্তিফৌজের যুদ্ধ চলছে। রাত্রে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা ও শোনাল একই বার্তা। এত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ও আশ্বস্ত হলাম, না, বাঙালী রুখে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

 পরদিন ২৭শে মার্চ। কয়েক ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন শিথিল। ভীতসন্ত্রস্ত চিত্তে ছুটে গেলাম জগন্নাথ হলে ছোট ভাই বাবুর খোঁজ। বাবু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্র লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। সারা হল এলাকা জনশূন্য-হল ভবনগুলি বিধ্বস্ত, অগ্নিদগ্ধ, রক্তাপ্লুত। নরমেধযজ্ঞের সাক্ষ্য হিসাবে তখন ও সিঁড়িতে, ছাদে, বিভিন্ন কক্ষে এখানে সেখানে পড়ে রয়েছে গুলিবিদ্ধ, বেয়োনেটবিদ্ধ অসংখ্য ছাত্রদের লাশ। রক্ত, মৃতদেহ আর বারুদের গন্ধে বাতাস ভরপুর। সামনে মাঠে সদ্যখাদিত এক গণকবর- অনেকেরই হাত পা বেরিয়ে রয়েছে। তখনকার মনোভাব আজ আর বুঝাতে পারবো না কেমন একটা আচ্ছন্ন ও মোহগ্রস্ততার মধ্য দিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম বাবুর দোতালার ঘর পর্যন্ত। সারা ঘর বিপর্যস্ত রক্তাক্ত। পেলাম না তার মৃতদেহ সন্ধান। বুঝলাম বাবু আর ও অনেকের সাথে গণকবরের অভ্যন্তরে শায়িত।

 দেখা করলাম তখন ও জীবিত গৃহ শিক্ষকদের সাথে- রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক গোপাল কৃষ্ণ নাথ, জগন্নাথ হলের নরমেধযজ্ঞের একজন নীরব সাক্ষী, দেখা হল সংস্কৃতির অধ্যাপক রবীন্দ্র ঘোষ ঠাকুরের সাথে। মুখে কার ও কথা নেই, এরা সবাই দিশেহারা, স্তব্ধ, জীবন্বৃত। দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলে পথে নেমে পড়লাম। ঐ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা- জগন্নাথ হল মিনার এলাকা, ইকবাল হল,