পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩১৫

নীলক্ষেত এলাকা ঘুরে দেখলাম। খবর সংগ্রহ করলাম যথাসাধ্য। সব এলাকা অত্যাচারক্লিষ্ট। রমনা কালীবাড়ী, আনন্দময়ী আশ্রয়, শিববাড়ী, কোন এলাকাই রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি রোকেয়া হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর আবাস এলাকাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব ভবন ও শক্তির দাপটের সাক্ষ্য বহন করেছে।

 পথে পথে মিলিটারী- চোখ চোখ তাদের দানবীয় দৃষ্টি। দৃষ্টিতে ঝরে পড়েছে ঘৃণা। তার মধ্য দিয়ে ক্লান্ত-ম্লান বিষণ্ন মুখে ফিরে এলাম বাসায়। এলাকা প্রায় জনশূন্য। সহকর্মীরা চলে গেছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। উদ্বিগ্ন মাতা, উৎকণ্ঠিতা স্ত্রী জানতে চাইলেন আমরা কোথায় যাব? বুঝতে পারছিলাম নিরাপত আশ্রয়ে চলে যাওয়া উচিত, কিন্তু কোথায় যাব? ঢাকার, বাংলাদেশের কোন স্থান আজ নিরাপদ? একবার ভাবলাম নদীর ওপারে জিঞ্জিরার দিকে যাওয়ার, যেদিকে সবাই যাচ্ছে। কিন্তু মিলিটারী চক্রব্যূহ ভেদ করে হাঁটাপথে সদরঘাট পর্যন্ত যাওয়ার ঝুঁকি অনেক, আর সেদিকের ও যেকি অবস্থা কে জানে। পরে শুনেছিলাম পলায়নপর নিরস্ত্র জনতার ওপর সদরঘাট এলাকায় নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে অসংখ্য নরনারী- এই পিশাচ বাহিনী।

 বেলা বারোটার দিকে এলেন সহকর্মী অধ্যাপক রফিকুল্লাহ আমাদের খোঁজে। জানালেন তারা আশ্রয় নিয়েছে ওর বড় ভাইয়ের ওখানে আমাদেরকেও সেখানে নিয়ে যেতে এসেছেন। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই পুনরাই কার্ফিউ জারী হবে, অতএব আর দ্বিধা না করে একরকম এক বস্ত্রেই গৃহত্যাগ করলাম।

 সেই কাল রাত্রিতে ও পরদিন জগন্নাথ হল ও তার আশেপাশের এলাকায় যে নির্মমতম হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তার প্রত্যক্ষদর্শী জগন্নাথ হলের তৎকালীন ছাত্র কালীরঞ্জন শীল হলে থেকে ও সেদিন অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন।

 শ্রী শীল সেই রাত্রে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হলে ও পরদিন সকালে মিলিটারীর হাতে ধরা পড়ে যায়। তাকে ও অন্যান্য অনেককে দিয়ে জগন্নাথ হল ও আশেপাশের এলাকা থেকে লাশ বহন করানো হয়েছিল। মিলিটারীর আনাগোনা কমলে তিনি সুইপারদের বস্তিতে একটি বাথরমে লুকিয়েছিলেন। পরে জনৈক ব্যক্তি সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে বুড়িগংগার তীরে পৌঁছে দেয়। জগন্নাথ হলে আক্রমণের আর একজন সাক্ষী ঐ হলের গৃহশিক্ষক শ্রী গোপাল কৃষ্ণনাথ।

 সেদিন পঁচিশে মার্চের রাত্রিতে ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ মেঠোকর্মিরা ও অধিনায়কগণ অপারেশন সম্পর্কে অয়ারলেসের মাধ্যমে কথোপকথন করেছিলেন তা জনাব জামিল চৌধুরী (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সম্প্রচার একাডেমীর পরিচালক) ও আর ও কয়েকজন রেকর্ড করেন।

 ২৭ শে মার্চ থেকে শুরু হল আমার পলাতক জীবন, আত্মগোপনের পালা। ঢাকার নানা স্থানে কখনও সপরিবারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালিয়ে বেড়িয়েছি। পরে জেনেছি বিশ্ববিদ্যালয় আবাসে একাধিকবার মিলিটারী আমার সন্ধানে গিয়েছিল। বহুবার বিপদের মধ্যে পড়েছি। তবু সাহস করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি সে সময় দেখেছি ওদের অত্যাচারের নানা রূপ অসহায়ভাবে। ওদের নারকীয় কাণ্ডকারখানা আর অত্যাচার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছি। সেই দুঃসময়ে ঢাকার আত্মগোপনে যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও আমাকে এবং আমার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল, নানাভাবে সাহায্য করেছিল তাদের কথা কোনদিন ভুলব না। ভুলব না ডঃ আজাদের কথা, ডঃ ওবাইদুল হকের কথা, ডঃ মুর্তজার কথা, অধ্যাপক এ, বি এম হবিবুল্লাহর কথা।

 অনেকবার বিপদের মধ্যে পড়েছি। একদিনের কথা বলি- দিনটি ছিল ১১ই এপ্রিল। ধানমণ্ডী আবাসিক এলাকায় এক পরিচিত বন্ধু পাট ব্যবসায়ীর ওখানে সপরিবার আশ্রয় নিয়েছিলাম কয়েক দিন আগে। বিকাল সাড়ে তিন বা চারটার দিকে একটি মিলিটারী জীপ কয়েকজন সেপাই ও অফিসারসহ বাসায় এল। আমরা উৎকণ্ঠিত ও শঙ্কাকুল চিত্তে অন্দরমহলে অপেক্ষা করছি। এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম। কিছুক্ষণপরে পরে ওরা চলে গেল। গৃহকর্তা জানালেন ওরা জানতে চাইল এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অধ্যাপক আশ্রয় নিয়েছে কিনা।