পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩১৬

গৃহকর্তা অনেক কষ্টে তাদের বিদায় করতে সমর্থ হয়েছেন অন্ততঃ সাময়িকভাবে। তিনি আরও জানালেন আমাদের সেখানে আর থাকাটা নিরাপদ নয়। ভাবলাম আবার যদি তারা ফিরে আসে তবে সবাই বিপদে পড়ব। এদিকে বিকেল ৫টায় আবার কার্ফিউ বলবৎ হবে, নতুন আশ্রয় স্থল খোঁজার সময় নেই। বন্ধুকে জানালাম যে আজ রাতের জন্য আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসই হবে সবচাইতে নিরাপদ স্থান,কেননা, যদি ওরা আমরা সন্ধানেই এসে থাকে তাহলে নিশ্চয় তারা ওখানে প্রথম খোঁজ করে এসেছে। ৫টার একটু আগে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বাসায় এসে আশ্রয় নিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তখন শ্মশানের নীরবতা, জন প্রাণী নেই, দু’একটা কুকুর কেবল ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন বাতি না জ্বালিয়ে সেই রাতে আমরা কাটালাম ভয়ে ভয়ে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ কোন বিপদ ঘটেনি। পরদিন আবার নতুন আশ্রয়ের সন্ধনে বেরিয়ে পড়লাম। আর একদিনের কথা- আজিমপুর এলাকায়। একটি গলির ভেতর একটি মেসে আশ্রয় নিয়েছি একা। রাতে এগারটার দিকে বেশ হৈ চৈ- চারদিকে চুটাছুটি, বন্দুকের গুলি। কিছুক্ষণ পর বুঝা গেল সমস্ত এলাকা মিলিটারী কর্ডন করেছে। ঘরে ঘরে তল্লাসী চলছে। মেসের অধিবাসী আমরা ক’জন আতঙ্কিত হয়ে অপেক্ষা করছি। কখন দুশমনদের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু আমাদের মেসে ওদের পদার্পণ ঘটেনি। পরদিন সকালে জানা গেল আশেপাশে এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন যুবক ও ছাত্রকে তারা ধরে নিয়ে গেছে। ভাবলাম এদের মধ্যে ক’জন জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবে!

 ২৭শে মার্চ সন্ধায় বিবিসি রেডিও অস্ট্রেলিয়ার বরাত দিয়ে জানাল যে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং তিনি চট্টগ্রাম রয়েছেন। অপরদিকে রেডিও পাকিস্তান ক’দিন ধরেই বলে চলেছে শেখ সাহেবকে ২৬শে মার্চ তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ২৮শে মার্চ বিকেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার কথা (শেখ সাহেবের পক্ষে) আমরা শুনলাম। এই দু’টি ঘোষণাই আমাদের বন্দী অসহায় জীবনে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল বলাই বাহুল্য।

 প্রায় প্রতিদিন কোন কোন এলাকায় নরহত্যা সংঘটনের খবর পেতে থাকলাম। শুনলাম ২৯শে মার্চ রাত্রে শাঁখারী বাজার ও তাঁতী বাজার এলাকায় হিন্দু নরনারীদের শেয়াল কুকুরের মত হত্যা করা হয়েছে। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে একদিন সাহস করে একা একা তাঁতী বাজার গেলাম। সেখানে আমার পূর্বপরিচিত জগন্নাথ কলেজের প্রধান ইতিহাসের অধ্যাপক নারায়ণ সাহা থাকেন তাঁর সন্ধানে। দেখলাম সারা এলাকা নিস্তব্ধ। ওর বাড়ী ফাঁকা। গলির মোড়ে এক পান বিড়ির দোকানে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম ওদের কথা। জানাল ওরা জিঞ্জিরায় চলে গেছে। নদীর ওপারে। সে আরও জানাল যে, তাঁতী বাজার আর শাঁখারী বাজার এলাকা এখন অবাঙালীরে দখলে, অধিকাংশ হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়ী ওদের দখলে। আমাকে ওদিকে যেতে নিষেধ করল। শাঁখারী বাজার এখন ‘টিক্কা খান রোড'।

 ২৮ শে মার্চ রাত্রে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে তোপ দেগে গুঁড়িয়ে দেয় হল। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতীক আমাদের সংগ্রামের প্রতীক এখন মসজিদে রুপান্তরিত। রিক্সা করে একদিন ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার কালে দেখলাম কারা যেন সবুজ রঙে বাংলা ও উর্দু বড় বড় হরফে লিখে রেখেছে “মসজিদ-মসজিদ”। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক রাত্রে ডিনামাইট দিয়ে ঐতিহাসিক রমনা কালী মন্দির উড়িয়ে দেয় হল ধূলিস্যাৎ করা হলেআনন্দময়ী আশ্রম। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে খবর পেলাম মোহাম্মদপুর এলাকার অনেক বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছে। শোনা যেতে লাগল প্রতি রাত্রেই কোন না কোন অঞ্চল থেকে লোক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে- এর সাথে চলছে লুটপাট, আর নারী নির্যাতন। শিশুরা ও বাদ পড়ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ-স্কুলের ছাত্রীরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সারা ঢাকা শহর ক্রমশঃ পরিণত হচ্ছে একটি বন্দিশালায়।

 এর মধ্যে আর একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছিল। অবাঙালীদের পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলসমূহ প্রতিদিনই মিছিল ও শোভাযাত্রা বের করতে শুরু করেছে পাক বাহিনী ও সরকারের