পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩১৭

সমর্থনে। এদের অনেকেই চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে সংঘটিত নৃশংসভাবে তথাকথিত অবাঙালী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অতিরঞ্জিত খবর পরিবেশন ও বক্তৃতা, বিবৃতি দিতে শুরু করল। এর প্রতিক্রিয়া ঢাকাতে অনুসৃত হল আরও বাঙালী নিপীড়ন, হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। শোনা যাচ্ছিল নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী নদীতে, ঢাকায় বুড়িগংগা নদীতে প্রতিদিনই অসংখ্য লাশ একত্রে বাঁধা অবস্থা ভেসে যায়। ঢাকা অবরুদ্ধ, বাংলাদেশ বাইরের জগতে থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। স্থির করলাম বাংলাদেশের প্রকৃত শাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সম্পর্কে, গণহত্যা সম্পর্কে বহির্বিশ্বকে যে করেই হোক জানাতে হবে। নরহত্যা ও নির্যাতন সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্যের একটি প্রতিবেদন তৈরি করলাম উপরোক্ত মেসের একজন রুমমেটকে দিয়ে। তার অফিস থেকে গোপনে কয়েক কপি টাইপ করলাম। যে করেই হোক এই প্রতিবেদন বাইরে পাঠাতে হবে। ডঃ আজাদের সাথে যোগাযোগ করলাম তাঁর প্রতিষ্ঠানে তখন ও ২/১ জন বিদেশী রয়েছন যারা এখনও ঢাকা ত্যাগ করেননি, তবে শীঘ্রই করবেন। একদিন বিকেলে ওদের একজনের সাথে ডঃ আজাদসহ দেখা করলাম। সবকিছু জানালাম এবং এ ব্যাপারে তার সহয়তা কামনা করলাম। তিনি সানন্দে রাজী হলেন এবং কিছু ছবিও তুলেছেন। এ সবই তিনি আমেরিকায় পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন এবং যাওয়ার সময় আরও তথ্য প্রদান করলে নিয়ে যাবেন সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির সহায়তায়। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আমাদের প্রথম কাজ শুরু হল। তিনিও জানালেন যে তিনি চলে গেলে ও একজনকে বলে যাবেন আমাদের সাথে যোগযোগ স্থাপনের জন্য।

 এদিকে ২৬ শে মার্চ থেকেই নরহত্যার পাশাপাশি বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে প্রাথমিক পর্ব শুরু হয়ে গেছে। ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশর সর্বত্র পাক বাহিনী প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। ইপিআর, পুলিশ, ইবিআর,প্রাক্তন সৈনিক, ছাত্র,জনতার মধ্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্থানীয়ভাবে মুক্তিফৌজ গড়ে উঠেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার মারফত স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম ও পারিপার্শ্বিক এলাকায় মেজর জিয়াউর রহমান ও ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা মেহের পুর সীমান্তে মেজর ওসমানের নেতৃত্বে;ময়মনসিংহে মেজর শফিউল্লিাহর নেতৃত্বে;ব্রাক্ষণবাড়িয়া, আখাউড়া এলাকায় মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে; সিলেট অঞ্চলে মেজর দত্তের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে। এই নামগুলি সেদিন অবরুদ্ধ ঢাকাবাসীর ছিল প্রেরণার উৎস।তখনই স্থির করেছিলাম পাকিস্তানী অধিকৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর চাকুরী নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে কোন কাজ করাই হবে পবিত্রতম কর্তব্য। প্রথম দিকে স্থির করেছিলাম ঢাকাতেই আত্মগোপন করে অবস্থান করে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে কাজ কারার চেষ্টা করব সীমিত সাধ্য নিয়ে। কেননা এটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে আমাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ টিকবে না, ভেঙ্গে পড়বে। গেরিলা যুদ্ধই হবে আমদের ভরসা, আর এজন্য প্রয়োজন দেশের অভ্যন্তরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ও থেকে যাওয়া। তাই সেই দুর্যোগকালে ও কয়েকজন সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম ঢাকায় থেকে প্রতিরোধের সপক্ষে কোন কিছু করা যায় কিনা। কিন্তু অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে লাগল। কার ও সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ঢাকায় অবস্থান করাও অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। প্রতিরাতেই ঢাকার কোন কোন এলাকা পাকিস্তানী হামলার শিকার হচ্ছিল।

 বুঝতে পারছিলাম সপরিবার ঢাকায় আর থাকা নিরাপদ নয়। শুভানুধ্যায়ীরা বিশেষ করে ডঃআজাদ পরামর্শ দিলেন ঢাকা ছেড়ে মুক্তাঞ্চলে চলে যাওয়ার। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অসুস্থ স্ত্রী আর বৃদ্ধামাতাকে নিয়ে। ১১ই এপ্রিল আকাশবাণীর মারফৎ জানলাম মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার কথা। ইতিমধ্যে স্বাধীনতার কথা ঘোষিত হয়েছে— যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। পরে আগরতলায় আমার এক ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জয়ের সাথে দেখা হওয়ায় তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা নোয়াখালী শহরে কিভাবে স্বাধীনতার কথা জানতে পারে। সে আমায় জানিয়েছিল যে, ২৭শে মার্চ সকাল থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এ সম্পর্কে মাইকযোগে প্রচার করতে থাকে এবং বঙ্গবন্ধুর বাণী সম্বলিত একটি হ্যাগুবিল জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তার মতে বঙ্গবন্ধুর এই বাণীটি টেলিগ্রাফ অফিসের কর্মচারীরা পান এবং তারা নেতৃবৃন্দকে জানান। এ ঘটনা থেকে আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধুর