পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩১৮

বাণীটি চট্টগ্রামে ধৃত হওয়ার পর টেলিগ্রাফ ও অয়ারলেসের কর্মচারীবৃন্দ বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন। তারা আবার অন্যান্য স্থানের সাথে যোগাযোগ করে। এই বাণী এভাবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারিত হয়। আরও অনেকর কাছ থেকে একই ধরনের কথা শুনতে পাই।

 ২২শে এপ্রিল। অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ যোগাযোগ করলেন একটি দুঃস্থ অসহায় হিন্দু পরিবারের জন্য আশ্রয় খুঁজতে হবে। ভদ্রলোক একজন সরকারী চাকুরে। তাঁকে কয়েকদিন হল মিলিটারী ধরে নিয়ে গেছে। আর ফিরে আসেননি। সকন্যা মহিলা বিপদে পড়েছেন। কন্যাটির প্রতি মিলিটারীর নজর পড়ছে। মিলিটারীর লোকজন প্রতিদিন আগাগোনা করছে, আর ভয় দেখাচ্ছে। টাকা দাবী করছে বাবাকে ছেড়ে দেবে এই বাবদে। মিসেস আব্বাসের সাথে যোগাযোগ করে ওদের একটি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলাম। আজিমপুরায় আমার এক পরিচিত হিন্দু সরকারী কর্মচারী পালাতে পারেননি, সরকারী নির্দেশে আবার কাজে যোগ দিয়েছেন। কয়েকজন অবাঙ্গালী তাকে ভয় দেখাচ্ছে, তারা বৈকালিক চা-পানের উদ্দেশ্যে। খবর পাঠিয়েছেন মেয়েটির জন্য কিছুদিনের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের সুলতানার সাথে যোগাযোগ করলাম। ও রাজী হল মেয়েটির একটি সুব্যবস্থা করার। আজিমপুরায় যে মেসে থাকতাম সেখানকার একজন একদিন সন্ধ্যায় জানালেন- তাকে তার অফিসে জনৈক অবাঙ্গালী কর্মচারী ভয় দেখাচ্ছে যে তিনি মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রাখছেন- টাকা চাইছে। স্থির করেছেন মুক্তাঞ্চলে চলে যাবেন, মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবেন। সব ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। পরদিন সকালেই চলে যাবেন। সকালে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলাম। তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

 স্থির হয়েছিল এপ্রিলের শেষে ঢাকা ত্যাগ করব। পুরানো এক রাজনৈতিক কর্মীবন্ধু মেসেজ পাঠিয়েছেন অবিলম্বে মুক্তাঞ্চলে সরে যাওয়ার জন্য। আমার জন্য ঢাকায় থাকা আর কিছুতেই নিরাপদ নয়। বার্তাবাহক সব ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু উদ্যোগ ব্যর্থ হল। মিলিটারী ব্যূহ ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। অর্ধপথ থেকে ফিরে এলাম আবার ঢাকায়। এবার অন্য সূত্র ধরলাম।দাউদকান্দি থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে ভিতরে এক গ্রামে আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের এক মামা থাকেন। সেখানে যাওয়া স্থির করলাম। ডঃওবাদুল হকের অফিসে ঐ অঞ্চলের কর্মচারীর সন্ধান পাওয়া গেল।সে খবর নিয়ে জানাল আমাদের আত্মীয়রা গ্রামে আছেন ওদিকে মিলিটারীর দৌরাত্ম্য নেই।মুক্তাঞ্চল বলা চলে।সে আমাদের ওখানে নিয়ে যেতে রাজী হল।ওর নাম নুরুল ইসলাম। স্থির হল নারায়ণগঞ্জথেকে লঞ্চ বা নৌকায় আমরা ঐ গ্রামের দিকে যাব।ডঃআজাদ পরামর্শ দিলেন হিন্দু পরিচয়ে কিছুতেই যাওয়া যাবেনা। যেতে হলে মুসলমান পরিচয়ে।কিন্তুবিপত্তি হল মাকে নিয়ে। মা কিছুতেই প্রথম জিজ্ঞাসাতে মুসলমান নাম বলতে পারেন না, মুখ দিয়ে আসল নাম বেরিয়ে আসে। অতএব স্থির হল আমরা রাস্তায় জিজ্ঞাসাবাদের পাল্লায় পড়লে নেটিভ ক্রিশ্চিয়ান পরিচয় দেব। নাম স্থির করার প্রয়োজন নেই। ক্রিশ্চিয়ানরা বাংলা নামেই পরিচয় দেয়। হলিক্রস কলেজের পরিচিত এক সিষ্টারের কাছ থেকে ‘ক্রশ’, কিছু বাংলা ও ইংরেজী বাইবেল ও অন্য পুস্তুক যোগাড় হল। মা ও স্ত্রী ‘ক্রশ’ঝুলালেন গলায়। স্থির হল ১৫ই মে আমরা ঢাকা ত্যাগ করব। ডঃ আজাদ ওর প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসাবে পরিচয় পত্র জোগাড় করে দিলেন।

 ঢাকা ত্যাগের কয়েকদিন আগে চক্ষু চিকিৎসক ডঃআলিম চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি পূর্ব পরিচিতি অসহায় আন্দোলনের সময়েই তার সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। তাঁকে সব জানালাম। তিনি সেদিন বলেছিলেন যে তাঁর প্রকাশ্য রাজনৈতিক কোন পরিচয় নেই উপরন্তু তিনি চিকিৎসক, কাজেই ঢাকায় থাকা তাঁর জন্য অতটা বিপদজনক নয়। স্থির হল তিনি ঢাকায় আগত গেরিলাদের যোগাযোগকারী ব্যক্তি হিসাবে কাজ করবেন। তাদের আশ্রয়, প্রয়োজনে চিকিৎসা ঔষধ পত্রাদি যোগানোর ব্যাপারেঅন্যান্যদের সহায়তায়। ডঃআজাদের সাথে যোগাযোগ রাখার কথাও তাঁকে বললাম। আর ও কয়েকজনের সাথে এ ব্যাপারে দেখা করলাম। সরকার ঘোষণা করেছে ১লা জুলাইর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য। যাওয়ার কয়েকদিন আগে বিভাগীয় প্রধান ইন্নাস আলীর সাথে দেখা করলাম তাঁর আজিমপুরস্থ অস্থায়ী বাসভবনে। তিনি পাকিস্তানীদের গুলিতে