পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩২০

উদ্দেশ্য ওকে জানালাম, ওরা আশ্রয় পেল যুবশিবিরে। কয়েকদিন অধ্যাপক আলমের সাথে কাজ করলাম রিক্রুটিং সেণ্টারে। দলে দলে যুবকরা আসছে সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। এদের রাজনৈতিক মতবাদ ভিন্ন, কিন্তু মাতৃভূমি উদ্ধারে দৃপ্ত শপথে সকলেই বলীয়ান। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সদাসতর্ক যেন উদ্বাস্তুদের সাথে পাকিস্তান চর বা গোয়েন্দা অনুপ্রবেশ না করতে পারে। একদিনের ঘটনা- বিকেলে থানা থেকে জনৈক পুলিশ এসে আমাকে জরুরী প্রয়োজনে থানায় নিয়ে এল থানা অফিসার জানালেন যে তারা গোয়েন্দা সন্দেহে কয়েকজনকে আজ আটক করেছে- সবাই পরিচয় দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে। আমি সনাক্ত করতে পারি কি না। সন্দেহের কারণ ওদের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের রাস্তা ঘাট ও নদীপথের মানচিত্র। আমার সাথে ও ধরনের কিছু ম্যাপ ও কাগজপত্র ছিল। ডঃআজাদ অন্যান্যদের সহযোগিতায় জোগাড় করে ঢাকা ত্যাগের সময় আমাকে দিয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর লোকজনদের কাজে লাগাতে পারে এই ভরসায়। ছাত্রদের সাথে থানা হাজতে কথা বলে সন্দেহমুক্ত হলাম, ওরা প্রকৃতই ছাত্র। কয়েকজন আমাকে চিনতে ও পারল। ওরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে এসেছে। অফিসারকে বলায় ওরা মুক্তি পেল কিছুক্ষণ পরে।

 মুক্তিযুদ্ধে আরো সক্রিয়ভাবে কাজ করতে চাই। তাই পরদিন আমরা এলাম আগরতলায়। সপরিবারে আশ্রয় নিলাম আগরতলায় কলেজের উদ্বাস্তু শিবিরে। কলেজের হোষ্টেলের একটি কামরায় আমাদের স্থান করে দিলেন সুপার শ্রী ভট্টাচর্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নানা ভাবে এবং উদ্বাস্তুদের দেখাশুনার ব্যাপারে শ্রী ভট্টাচার্য যে অমূল্য অবদান রেখেছেন তা আমি আজ ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। হাজার হাজার শরণার্থী- সাধারণ মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক। দেখা হল ছাত্রনেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন সহ বেশ ক'জন ছাত্রনেতার সাথে, দেখা হল জনাব জিল্লুর রহমান ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে। নেতাদের জানালাম যে আমি ভারতে এসেছি উদ্বাস্তু হিসাবে থাকার জন্য নয়, মুক্তিযুদ্ধে কাজ করতে।

 সেদিন বিকেলে ভারতীয় চলচ্চিত্র, ডকুমেনটেশন বিভাগ আমার একটি সাক্ষাৎকার চিত্রায়িত করল। ঢাকা ও বাংলাদেশের যে গণহত্যা চলেছে তার একটি বিশদ বিবরণ দিলাম। এই চিত্রায়ন পরে ভারতের নানা স্থানে প্রদর্শিত হয়েছিল। পরদিন ছিল নজরুল জয়ন্তী, সত্যবাবুর উদ্যোগে উদ্বাস্তু ও যুবশিবিরের ছাত্ররা অনুষ্ঠান করল। আমরা অনেকেই বক্তৃতা করলাম। দেখা হল চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীর সাথে। তাঁকে সব জানালাম। তিনি পরামর্শ দিলেন কোলকাতায় চলে যাওয়ার জন্য। সেখানে মুজিব নগরস্থ বাংলাদেশ সরকার ও ডঃ এ আর মল্লিকের সাথে দেখা করার জন্য। সেখানে আমাদের মত লোকের নাকি বিশেষ প্রয়োজন।

 স্থির করলাম কোলকাতা চলে যাওয়ার। কয়েকদিন শরণার্থী শিবির ও যুবশিবির ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশ থেকে আগত বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনদের কাছ থেকে বাহিনীর অত্যচার সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম। দেখা হয়েছিল দেবদাস চক্রবর্তী ও ডঃ এস আর বোসের সাথে। সমস্যা দেখা দিল অসুস্থ স্ত্রী ও মাকে নিয়ে। ওঁদের চিকিৎসা ও বিশ্রামের প্রয়োজন। স্থির হল আসামে শিবসাগরে কর্মরত বড় ভইয়ের কাছে মা ও স্ত্রীকে রেখে আমি কোলকাতায় চলে যাব। চিঠি লিখলাম কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনে ডঃ এ আর মল্লিকের কাছে আমার আসামের ঠিকানা জানিয়ে। প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় আসামে পৌঁছলাম কয়েকদিন পরে। কিন্তু আসামে এসে বিপদে পড়লাম আসাম কর্তৃপক্ষ আদেশ জারী করেছেন উদ্বাস্তুদের সব রকম চলাচল নিষিদ্ধ করে। বড় ভাই চেষ্টা করতে লাগলেন আমার কোলকাতা যাওয়ার অনুমোদন লাভের। দেরী হচ্ছিল। এরই মধ্যে ডঃ আনিসুজ্জামান এবং ডঃ মল্লিকের পক্ষ থেকে তার কন্যা আমার ছাত্রী সেলিনার চিঠি পেলাম। ত্বরিত কোলকাতা যাওয়ার কথা দু'জনেই লিখেছেন। অনেক নাকি কাজ। আসাম সরকারেরও অনুমতি পাওয়া গেল।

 কোলকাতার পথে গৌহাটিতে একদিন অবস্থান করলাম। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী শিক্ষকদের সাথে দেখা করলাম। ওদের আসামে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির প্রয়াসে কাজ করার আবেদন জানালেন। তড়িঘড়ি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওরা একটি সভারও আয়োজন করল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বক্তব্য রাখলাম, আসামবাসীদের সহযোগিতা কামনা করলাম। আসাম থেকে এলাম উত্তরবংগে। শিলিগুড়ি, রামগঞ্জ