পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১০

নারায়ণও আমাদের সমর্থনে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আমার এলাহাবাদ সফরকালে তিনি তাঁর রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এক বিরাট জনসমাবেশের আয়োজন করেন এবং সমাবেশের তোরণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট এক প্রতিকৃতি স্থাপন করেন। দলের কর্মকর্তা ও কর্মীদের আগ্রহে আমি ওই সমাবেশে তাদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিই। সে সময় ভারতে বাংলাদেশের সমর্থনে এমন একটি জোয়ার এসেছিল সে সব জায়গায়, এমনকি দুর্গাপূজা মণ্ডপের প্রবেশ দ্বারেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানানো দেখেছি।

 বোম্বেতে অবস্থানকালে মহারাষ্ট্রের গভর্নর নবাব আলী জংগ-এর সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়। বাংলাদেশের সমর্থনে আয়োজিত সভায় তিনি উপস্থিত হন এবং আমার বক্তৃতা শোনেন। বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রচুর অর্থ, গেরিলাদের জন্য পোষাক-পরিচ্ছদ ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ মুক্ত হবার পর আমি যখন দিল্লীতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলাম তখন প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যে একদিন হঠাৎ নবাব ইয়ার আলী জংগ আমার বাসায় এসে উপস্থিত হন এবং বলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য আমি যে তহবিল খুলেছিলাম তাতে প্রচুর টাকা জমা হয়েছে। যেহেতু এ টাকা আমাদের জনসাধারণ কর্তৃক বাংলাদেশকে দেয়া তাই এটি আপনাকে নিতে হবে। মহারাষ্ট্রে তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল। সুতুরাং এ বিষয়ে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগে কথা বলি। মহারাষ্ট্রের গভর্নও সাহায্য তহবিলের যে চেক প্রদান করেন তা আমি বঙ্গবন্ধুকে পঠিয়ে দিয়ে সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতীকী সাহায্য হিসেবে মহারাষ্ট্রের জনগণকে দেবার পরামর্শ দিই। অতঃপর তাই করা হয়।

 শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে সৈয়দ আলী আহসানকে একবার বাঙালোরে এবং মযহারুল ইসলামকে কেরালাতে বক্তৃতা দিতে পাঠানো হয়। সৈয়দ আলী আহসান, মযহারুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান মাঝে মাঝে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। আমিও দুবার অংশ নিয়েছিলাম।

 সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে (১৮-২০ তারিখ) দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। “World Meet on Bangladesh” নামে এটি পরিচিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। সেখানে ২৪টি দেশের ১৫০জন প্রতিনিধি সমবেত হন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা রুপে আমি এই সম্মেলনে যোগ দেই। অন্যান্যদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান, মওদুদ আহমদ ও আবিদুর রহমান প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন। সম্মেলন খুব সফল হয় এবং বিশ্বজনমত গঠনে আনুকূল্যও সৃষ্টি করে। এই সম্মেলনের সাফল্যের পিছনে গান্ধী ফাউণ্ডেশনের বেশ অবদান আছে। এখানে অমরেশ সেন এর ভূমিকা ও তৎপরতা উল্লেখযোগ্য। এখানে একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বি, পি, কৈরালা অমরেশ সেনের বাসায় গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রামে গুর্খাদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেন। সে সময়ে তিনি ভারতে আশ্রিত ছিলেন বলে তাঁর এই প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয়, একথা তাঁকে জানাই। তবে তাঁর এই আগ্রহের কথা আমি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকে জানাবার আশ্বাস দিই। পরবর্তীকালে একথা জানালে তাজউদ্দীন আহমদও এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে ঐক্যমত্য প্রকাশ করেন যে, ভারতে আশ্রিত কোন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীর সহায়তা আমাদের নেয়া উচিত হবে না।

 দিল্লীর আন্তর্জাতিক সম্মেলন শেষ করেই আমি নিউ ইয়র্কের পথে রওয়ানা হয়ে যাই। বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রচারকার্য চালানো ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার তখন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৫জন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। আমি এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, শিক্ষকদের মধ্যে রেহমান সোবহানও ছিলেন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে আবদুস সামাদ আজাদ, এম আর সিদ্দিকী, ফণি মজুমদার, সিরাজুল হক, আর ছিলেন সৈয়দ আবদুস সুলতান, ডাঃ আসহাবুল হক এবং ফকির সাহাবুদ্দিনের মতো সংসদ সদস্য; এস, এ করিম, আবুল ফাতাহ ও এ, এম, এ মুহিতের মতো বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী প্রক্তন পাকিস্তানী কূটনীতিবিদ। আমাদের এই প্রচেষ্টার সাফল্য সম্পর্কে অনেকেই অবহিত আছেন।