পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১১

 জাতিসংঘের অন্যান্য কয়েকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি পর্তুগালের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়ও আমার কার্যাবলীর অন্তর্ভূক্ত ছিল। একদিন আমি জাতিসংঘ ভবনে পর্তুগীজ দূতের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলাপ করছি, তাঁকে আমাদের সংগ্রামের পটভূমি বিশদভাবে বুঝাচ্ছি ঠিক সে সময় আমাদের সামনে দিয়ে হলের ভেতরে যাচ্ছেন পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের সদস্য শাহ আজিজুর রহমান, মাহমুদ আলী, রাজিয়া ফয়েজ প্রমুখ। এঁরা যাবার সময় পর্তুগীজ দূত আমাকে আঙ্গুলের ইশারায় বললেন, ঐ দেখুন, আপনাদের প্রতিপক্ষরাও যাচ্ছেন। রাজিয়া ফয়েজ আমার পূর্ব পরিচিতা ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে আমার কাছে এসে হোটেলে আমার ঠিকানা জানতে চাইলেন এবং রাত দশটার পর আমার সঙ্গে দেখা করবেন, বললেন। নির্ধারিত সময়ে তিনি জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আমাকে এই বলে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, আপনার মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ যাঁদের সঙ্গে কাজ করছেন তাঁদের নেতা হলেন তাজউদ্দীন প্রমুখ ব্যক্তি। আমি বললাম তাঁরা জনগণের প্রতিনিধি। গণপ্রতিনিধিরা আমার চাইতে বেশী সম্মানের দাবিদার। সব দেশে তাঁরাই সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। আমার বেলায়ও তাই হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা লিপ্ত আছি। কে বেশী সম্মানিত কে কম সম্মানিত এ প্রশ্ন এখানে ওঠে না। তাঁকে আমি বলি, আমার দৃঢ়বিশ্বাস, দেশ স্বাধীন হবে এবং তার আর বেশীদিন বাকী নেই। বাংলাদেশে গেরিলাদের হাতে প্রতিদিন যত পাক সৈন্য মারা যাচ্ছে তাদের সংখ্যা পাকিস্তান সরকার গোপন করতে চাইলেও বিদেশী সাংবাদিকরা তাদের হতাহতের যে সংবাদ দিচ্ছেন তাতে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। তখন তিনিও অধিক হারে পাক সৈন্য ক্ষয়ের কথা স্বীকার করলেন। আমি তাঁকে আবার প্রশ্ন করি, আপনার এই শারীরিক অবস্থায় আপনি কিভাবে এসেছেন? উল্লেখ্য যে তিনি তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন। তিনি জানান, ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের চাপে আমাকে অনিচ্ছা ও অসুবিধা সত্ত্বেও আসতে হয়েছে। সন্তান ধারনের ৭ মাস অতিবাহনের মেডিক্যাল সার্টিফিকেট প্রদান করা সত্ত্বেও আমাকে অব্যহতি দেয়া হয়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর অন্যান্যদের সঙ্গে যখন তাঁকেও বাংলাদেশের বিরোধিতা করার কারণে জেলে পাঠানো হয়েছিল তখন তাঁর স্বামী ও তাঁর বোন আমার কাছে আসেন তাঁর মুক্তির ব্যাপারে বলার জন্য। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর সম্পর্কে একথার ওপর জোর দিয়ে বলি যে, তিনি ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন, অতঃপর অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও জেল থেকে মুক্তি পান।

 জাতিসংঘে দায়িত্বপালনের সঙ্গে সঙ্গে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সম্পর্কে শিক্ষক, ছাত্রদের সমাবেশ ও জনসভায় বক্তৃতা করি। প্রসংগতঃ উল্লেখ যে, এ সময়ের ১০ বৎসর পূর্বে আমেরিকার এক বিখ্যাত ও প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলাম[১] এবং তার আগে ও পরে আমেরিকাতে বিভিন্ন সেমিনার ও কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। এর ফলে ঐ দেশের বহু শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ আমার পরিচিত ছিলেন। অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন উদ্যোগী হয়ে আমার জন্য এ রকম বিশেষ প্রোগ্রাম এর ব্যবস্থা করেন। এতে বাংলাদেশ সরকারের কোন অর্থ ব্যয় হয়নি। তবে আই, আর, সি নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাও এখানে কিছুটা সহায়কের ভূমিকা পলন করেছিল।

 যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত আমার প্রাক্তন ছাত্র জে, আর খান এ সময়ে আমার সচিবের কাজ করেন। আমি বক্তৃতা দিই নিউইয়র্ক, কলাম্বিয়া, পেনসিলভানিয়া, ষ্টানফোর্ড, বার্কলে লংবীচ, শিকাগো, বাফেলো, প্রিন্সটন, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলাইন, হার্ভার্ড, বষ্টন, ইয়েল প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটিভাবে আমার কর্মসূচী হতো স্থানীয় রেডিও টিভি সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার প্রদান, মধ্যাহ্নের ফ্যাকাল্টি সদস্যদের সমাবেশে বক্তৃতা দেয়া এবং অপরাহ্নে উন্মুক্ত স্থানে ছাত্র সমাবেশে বাংলাদেশের ওপর বক্তৃতা দিয়ে সমর্থনের আহ্বান জানানো। উল্লেখ্য যে, এরূপ অনেক ক্ষেত্রে আমার বক্তৃতার পর শ্রোতারা মার্কিন সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতেন। সেটি আমাদের জন্য একটা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক পরিস্থিতি বলে বিবেচিত হতো। আমার সঙ্গে প্রায়ই থাকতেন ডাঃ আসহাবুল হক। তাছাড়া আমার অনুরোধে ও আয়োজনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, সৈয়দ আবদুস সুলতান, ডাঃ আসহাবুল হক, সিরাজুল হক প্রত্যেকে এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা


  1. পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশীয় ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর।