পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৩৫

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড

চাপ দিতে-অন্ততঃ তাদের জীবন যেন নিরাপদ থাকে। কথা দিলেন যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। মেসেজ ত্বরিত পাঠবেন আই আর সি-র হেড অফিসে। তাছাড়া যোগাযোগ করবেন আমেরিকান দূতাবাসের সংগেও। সমিতির সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন দুতাবাসে ও বিদেশের বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের কাছে (জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলসহ) জরুরী বার্তা পাঠালাম।

 জয়নুল আবেদীন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, ঢাকা থেকে চলে এসেছেন। ওঁর কাছ থেকে ঢাকার বিস্তারিত খবর পাওয়া গেলে। ঢাকায় গেরিল দের কর্মতৎপরতার কথা জানা গেল। খবরে পাওয়া গেল মুনীর চৌধুরীর, অধ্যাপক হাবিবুল্লাহর কবি শামসুর রহমনের, হাসান হাফিজুর রহমানের। তিনি আরও জানালেনঢাকার কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সাহসিকতার সাথে।

 ঢাকা থেকে আমার ছাত্র ও সহকর্মী ডঃ একরামুল ইসলমের কাছ থেকে বার্তা এসেছে। ও জামালপুরের একটি স্থানীয় গেরিলা ইউনিটের সাথে কাজ করছে। ঢাকা থেকে টাকা পয়সা, ঔষধপত্র সরবরাহ করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু অস্ত্রের বেশী পয়োজন। যথাস্থানে যোগাযোগের ব্যাবস্থা করে দেয়া হল।

 অবশেষে এল সেই দিন ৩রা ডিসেম্বর। সন্ধা সাতটায় এলগিন রোডে নেতাজীভবনে সম্বর্ধনা সভাউত্তর ইউরোপীয় কয়েকটি দেমের ডেমোক্রেটিক সোস্যালিষ্টিদের একটি প্রতিনিধিদলের আগমন উপলক্ষে। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করান হচ্ছে তাদের। হঠাৎ শিক্ষক সমিতির জকৈ কর্মী সভা থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে এল। জানাল, পাকিস্তানী বিমান ভারতের গভীরে নানস্থানে হামলা চালিয়েছে। আনমেদ চিৎ করে উঠছিলাম সেদিন। আমাদের স্বাধীনতা আসন্ন। যুদ্ধ শুরু হল। ভারতীয় বাহিনী যোগ দিলেন আমাদের সাথে মিত্র বাহিনীরূপে।

 তারপর সাফল্য আর সাফল্য। প্রতিদিনা পতন হতে লাগল বিভিন্ন শহরে। ঐস্বাধীনতা। ঢাকা আর কতধূর। যশোর মুক্ত। মুক্ত দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহ। ঢাকা অবরুদ্ধ। মুক্তিবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে। গেরিলারা অভ্যনাতরে। বিজয় আসন্ন।

 কিন্তু এরই মধ্যে হৃদয়বিদারক খবর এল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৩ ই ডিসেম্বর পাকসৈন্য ও তাদের অনুচরেরা হত্যা করেছে ৪০ জন বিশিষাট নাগরিককে। বিচলিত হয়ে পড়লাম, আসঙ্কা করলাম হয়তো ঢাকাতেও অনুরূপ ঘটেছে বা ঘটতে চলছে। কোলকাতায় মিত্র বাহিনীর সদর দপ্তরের সাথে বি, এস এফ এরসাথে যোদাযোগ করে আবেদন জানালাম যে করেই হোক, ঢাকাস্থ বুদ্ধিজীবিদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবন রক্ষা করতে হবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘন ঘন আবেদন জানন হলনাগিরিকদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার। কিন্তু আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। স্বাধীনতার প্রাকমুহুর্তে আমরা হারালাম শ্রেষ্ঠ সন্তানদের চরম মূল্য দিতে হল স্বাধীনতার।

 তবু এর মধ্য দিয়ে এল স্বাদীনতা। মুক্তি। বিজয়। আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানী বাহিনী, বিনাশর্তে, যৌথ কম্যাণ্ডের কাছে। দিনটি ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।

 বিনা দ্বিধায় স্বীকার করব মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিই ছিল আমার জীবনের স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার যে সুযোগ ঈশ্বর আমায় দিয়েছিলেন সেজন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ। নানা স্মৃতিতে ভাস্বর এই দিনগুলুি কখনও মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছি, কখনও হতাশায় ভুগেছি, আবার খখনও আনন্দে উদ্বেল চিত্তে শিহরিত হয়েছি। নানাজনের কাছে নানভাবে সহায়তা লাভ করেছি, এজীবনের জন্য নানাজনের কাছে কৃতজ্ঞ। নাম করতে গেলে তালিকা হবে দীর্ঘ, তাই কারও নাম কবর না, সকলের কাছে ক্ষমা চাইব। কিন্তু তবু চান্দিনার কাছে একটি ছোট খালের ধারে, ঝোপের আড়ালে অবস্থিত পর্ণকুটিরে যে বৃদ্ধা মহিলা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন মায়ের স্নেহে, নিঃশঙ্কোচে, তার কথা কি কোনদিন ভুলতে পারব?

ডঃ অজয় রায়