পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৩

করেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রচার কার্যে তার আর্থিক অবদানও ছিল বিরাট। আমি এক রাতের জন্য তাঁর অতিথি ছিলাম। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক বন্ধু অধ্যাপক ডিমকও বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে সহায়ক শক্তি হিসেবে প্রচুর কাজ করেছিলেন।

 লংবীচে, আমার মনে পড়ে, একটি সমাবেশে ভাষণ দেবার পর বাংলােদশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেতার বাদক রবি সঙ্কর-এর সঙ্গে আমার সক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান এবং যে যন্ত্র সংগীতের মধ্যমে তিনি বাংলাদেশের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিলেন তার একটি রেকর্ড আমাকে উপহার দেন।

 বষ্টন ও হর্ভার্ডে বিমানবন্দরে আমাকে রিসীভ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন আমাদের কয়েকজন সিভিল সার্ভিসের সদস্য। তাঁরা আমার সঙ্গে বিভিন্ন জনসভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত জনাব খুরশিদ আলম একটি সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। ডঃ মহিউদ্দীন আলমগীরও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পক্ষে জনসমর্থনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানের একজন বিশেষ উদ্যোক্তা ছিলেন। আমার জন্য তার সযত্ন আতিথ্যের কথাও আমার মনে আছে।

 নভেম্বরের শেষ দিকে নিউইয়র্ক থেকে কলকাতায় ফেরার পথে লণ্ডনে বাংলাদেশীদের সমাবেশেও আমি বক্তৃতা দেই। সেখানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্রবাসী বাঙ্গালীদের বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সেখানকার বাঙ্গালীরা যথেষ্ট মনোবল নিয়ে কাজ করছিলেন। বস্তুতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র এবং লণ্ডনে বাঙ্গালী সমাজের মধ্যে ঐক্যের যে বোধ, সংগ্রামের যে সংকল্প এবং ত্যাগ স্বীকারের যে মনোভাব আমি লক্ষ্য করি, তাতে মুক্তিযুদ্ধের পরিণাম ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলিষ্ঠ আশার সঞ্চার হয়। লণ্ডন ছাড়া বৃটেনের লিভারপুল অক্সফোর্ড, ক্যামব্রীজ ইত্যাদি স্থানে এবং ইউরোপের বিভিন্ন শহরে গিয়ে আমার বক্তৃতা দেবার কথা ছিল। কিন্তু এটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, আমরা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি এবং বাংলাদেশ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে পাকিস্তান শীঘ্রই ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে। পাকিস্তানের পক্ষে এর একটি কৌশলগত ধারণা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিপন্ন করতে পারলে বাংলাদেশ প্রশ্ন চাপা পড়ে যাবে। পরবর্তীকালে নিরাপত্তা পরিষদে ভূট্টোর বক্তৃতা (হাজার বছর ধরে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ অঙ্গীকার) আমার ধারণা যে সঠিক ছিল তার প্রমাণ বহন করে। যাহোক, উপমহাদেশে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার আসন্ন অবস্থার দরুন আমার উক্ত সফরসূচী বাতিল করে দিল্লী হয়ে আমি কলকাতা ফিরে আসি।

 কলকাতায় ফেরার অল্পকাল মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায় শুরু হয়ে যায়। ঐ সংকট মুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার জনসভায় যে বক্তৃতা করেন, তা আমি বেতারে শুনি ঘরে বসে। সত্যি বলতে কি, সে বক্তৃতা শুনে আমি আশাহত হয়েছিলাম। কেননা আমার আশা হয়েছিল যে, ঐ সময় হয়তো বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়ে তিনি কিছু বলবেন। তারপর সেই রাতেই আকস্মিকভাবে ভারতের ওপর পাকিস্তানী হামলার সংবাদ শোনা গেল। এর পরপরই ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত বাহিনীর দ্রুত অগ্রগতি সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল আরো তাড়াতাড়ি এরা ঢাকায় পৌঁছাতে পারছে না কেন। তারপর যেদিন পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের সংবাদ হলো সেদিন দেখলাম বড়দিনের আরো কিছু দেরী আছে। উল্লেখ্য, সিদ্ধার্থ সংকর রায়কে আমি খ্রীষ্টমাসে স্বাধীন বাংলাদেশে আসার অগ্রিম আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম গত জুন মাসে।

 মুক্তিলাভের এই আনন্দ দ্রুত ম্লান হয়ে গেল ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যার সংবাদে। আমার কত আপনজনই না দেশদ্রোহীদের ষড়যন্ত্রে অকালে শহীদ হয়েছেন। তবু বারবার নিজেকে বলেছি, এত শহীদ, এত আত্মত্যাগীর মর্যাদা যেন আমরা রক্ষা করতে শিখি স্বাধীন বাংলাদেশে।

 দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ আমাকে বলেন যে, আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিদ, ছাত্র-যুবক, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই আপনার প্রত্যক্ষ ছাত্র। তারা আপনার কথা শুনবে। বিজয়ের পর প্রত্যেকে যাতে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয় এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা না ঘটে সেজন্য স্বাধীন