পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৬

 পাক সেনাদের ১০/১৫ জনের একটি দল শিল্প এলাকাতে ছিল। তারা উক্ত সংবাদ শোনার সাথে সাথে হাতিয়ার ফেলে রেখে পাবনা থেকে বের হয়ে আরিফপুর গোরস্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। জনতা এই সংবাদ শোনার সাথে সাথে উক্ত গোরস্থানে গিয়ে ঘেরাও করে। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর কয়েকটি কবর থেকে ৫/৭ জন পাক সেনাকে টেনে বের করে তাদেরকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। ৪/৫ জন পাক সেনা গোপালপুর মিলের কাছে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়লে তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। অতঃপর পাবনা শহর সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যায়। এবং আমরা সেখানে অবার বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। সেখানকার অফিস আদালত আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলতে থাকে।

 ২৫শে মার্চের পর পাক-বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। পাবনাতে পাক-বাহিনী যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আমরা রাজশাহী-পাবনা রোড, পাবনা-ঈশ্বরদী রোড, পাকশী-পাবনা রোডে ১৫/২০ জনের এক একটি দল প্রতিরোধ করার জন্য পাঠাই। আর আমরা বকুলের নেতৃত্বে নগরবাড়ী ঘাটে গিয়ে অবস্থান নেই। আমরা সেখানে গিয়ে দেখতে পাই বগুড়া থেকে ক্যাপ্টেন হুদা ৫০/৬০ জনের একটি ইপিআর ও আর্মি বাহিনী নিয়ে নগরবাড়ীতে পৌঁছেছেন। আমরা তাঁর বাহিনীর সাথে যোগ দিই।

 ১২ই এপ্রিল পাক-বাহিনী বিমান থেকে নগরবাড়ীতে আমাদের উপর বোমা বর্ষণ করে। ঐদিন ১০টার সময় ২/৩টি ফেরী ভর্তি পাক সেনা আরিচা থেকে নগরবাড়ী চলে আসে। এসেই তারা শেলিং করে এবং মেশিনগান থেকে আমাদের দিকে এলোপাতাড়ি গোলবর্ষন করতে থাকে। ২/৩ ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ চলার পর আমরা তাদের ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে ক্যাপ্টেন হুদার নির্দেশে দল তুলে নিয়ে পাবনার দিকে চলে যাই।

 পাক-বাহিনী নগরবাড়ী প্রবেশ করে। তাদের এক কোম্পানী শাহজাদপুরে চলে আসে আর এক কোম্পানী পাবনার দিকে রওয়ানা হয়ে যায়। পথে কাশিনাথপুরে পাক-বাহিনী আমাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেখানে ২/৩ ঘণ্টা সংঘর্ষের পর আমরা পাবনা হয়ে মুলাডুলি গিয়ে ডিফেন্স গ্রহণ করি। সেখানে ৩/৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পর ৬/৭ জন ইপিআর ও ১০/১৫ জন লোক নিহত হয়।

 ১৫/১৬ই এপ্রিল আমরা বোনপাড়া যাই। সেখানে পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধে আমাদের ৫/৭ জন ইপিআর শহীদ হন। সেখান থেকে আমরা রাজশাহী জেলার সারদাতে পৌঁছি এবং সেখানে পাক-বাহিনীর সাথে যুদ্ধে আমাদের ২জন মেশিনগান চালক পাক-সেনাদের গুলিতে আহত হন। আমি তাদেরকে উদ্ধার করতে গেলে পাক-সেনাদের একটি শেলের কণা এসে আমার বুকের বাম পাশে লাগলে আমি আহত হই। তারপর তাদেরকে রেখে কোনরকমে আমার বাহিনীর সাথে রাজশাহী জেলার নওগাঁ গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। তারপর সেখান থেকে হাসপাতালে ভর্তি হই। প্রায় দেড় মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠি। তারপর কলকাতা চলে যাই। সেখানে গিয়ে বকুলসহ পাবনা জেলার অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা হয়। তাদেরকে নিয়ে বকুলের নেতৃত্বে আমরা প্রথমে শিকারপুর ক্যাম্প করি। সেখানে ১০/১৫দিন থাকার পর আমরা কেচুয়াডাঙ্গায় ক্যাম্প করি।

 সেখানে প্রায় ১৫০ জন ছেলে বকুলের অধীনে প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। জুন মাসে ৪৪ জন ছেলেকে নিয়ে মুজিব বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য দেরাদুন যাই। দেরাদুনে সাপ-বিচ্ছুর দারুণ প্রকোপ ও নানা অসুবিধা সৃষ্টি হওয়ায় আমরা চাকার্তা চলে যাই। সেখানে আমরা মোট ৪৫ দিন বিভিন্ন প্রকার অস্ত্রশস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ

আগষ্ট মাসে ২/৩ তারিখে আমরা জরপাইগুড়ি চলে আসি। সেখানে ৮১০ দিন থাকার পর জলঙ্গী বডৃর দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করি এবং পাবনা পাকশী ব্রীজের নিকটে এসে পাক-সেনা দ্বারা বাদাপ্রাপ্ত হলে আমরা বারতে চলে যাই।

 ১৭ই আগষ্ট আমরা কুষ্টিয়ার বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি এবং সাঁথিয়া থানার সোনদহ ব্রীজে রাজাকরদের আক্রমণ করি। এতে ৩ জন রাজাকার নিহত হয় এবং একজন রাজাকার জীবিত ধরে নিয়ে আসি। অতঃপর আমরা পাবনা জেলার বোনাইনগর, ফরিদপুর থানায় প্রবেশ করি।