পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৮

কক্ষে প্রবেশ করে দেখি ডজনখানেক পদস্থ পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার আলোচনারত। আমার আকস্মিক ও অনভিপ্রেত উপস্থিতি তাদের মধ্যে একটা অপ্রস্তুত ও কিছুটা বিরূপ ভাবের সঞ্চার করলো। তাদের এ মনোভাব বুঝতে আমার অসুবিধা হল না। আমি বিশেষ আর কোন আলোচনা না করে ফিরে এলাম।

 ১লা মার্চ। শাহীন স্কুলের বার্ষিক ক্রীয়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পূর্ব পাকিস্তানের এয়ার অফিসার কমাণ্ডিং এয়ার কমোডর মাসুদের সভাপতিত্ব করার কথা। আগে দেখেছি এ ধরনের অনুষ্ঠানে তার উপস্থিত সব সময় ছিল সাগ্রহ। কিন্তু সেদিন দেখলাম তার ব্যতিক্রম। এয়ার কমোডর আমাকে বল্লেন আমি যেন তার পরিবর্তে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করি। দুপুর একটায় জেনারেল ইয়হিয়া পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ৩রা মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করলেন। বিদ্যুত গতিতে ঢাকার চেহারা পাল্টে গেল। চারিদিকে বিক্ষোভ। শাহীন স্কুল প্রাঙ্গণ থেকেই দেখলাম বিক্ষুব্ধ জনতার এক বিশাল মিছিল অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে শ্লোগান দিতে দিতে মহাখালী থেকে শহরাভিমুখে ধাবমান।

 ঘটনা দুটো উল্লেক করলাম এজন্য যে এগুলো থেকে আমার দৃঢ়বিশ্বাস জন্মেছে যে, ১লা মার্চে জেনারেল ইয়াহিয়ার পরিষদ অধিবেশন স্থগিত কোন আকস্মিক ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ঘোষণার প্রস্তুতি আগে থেকেই চলছিল এবং এ কারণেই এয়ার কমোডর মাসুদ আমাকে পুরস্কার বিতরণী সভার দায়িত্ব দিয়ে নিজে ইয়াহিয়ার ঘোষণা-পরবর্তী সম্ভাব্য পরিস্থিতি সম্পর্কিত কাজে ব্যাপৃত ছিলেন।

 ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনে আমাকে প্রায়ই ঢাকা বিমান বন্দরে যেতে হত। ফেব্রুয়ারীর তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই লক্ষ্য করলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বোয়িং ভর্তি সৈন্য ঢাকায় আনা হচ্ছে। তাদের সাথে আর্মীর স্পেশাল কমাণ্ডো সেনারাও আসছে এবং তাদের ব্যাগ-ব্যাগেজ নামছে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে এটা দেশের দু’অংশের মধ্যে সৈন্য বদলী ও যাতায়াতের একটা সাধারণ ঘটনা নয়। যারা আসছিল তাদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা আমার সন্দিগ্ধ হওয়ার কারণকে আরও জোরদার করছিল। তদানীন্তন ডিএফআই ডাইরেক্টরের একজন উচ্চপদস্থ বাঙ্গালী অফিসারকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেও সঠিক উত্তর পাইনি।

 মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকেই পরিস্কারভাবে অনুভব করলাম যে আমাকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও অন্যান্য কার্যকলাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। উপরমহল থেকে এ ধরনের আচরণ অপ্রত্যাশি হলেও এর কারণ আমার নিকট অবোদগম্য ছিল না।

 সারা পূর্ব পাকিস্তান তখন প্রতিবাদমুখর। মানুষ তাদের নিজ নিজ পন্থায় এ অন্যায়ের মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখলাম ইকবাল হলের ছাত্ররা কয়েকটি মাত্র পুরোনা ৩০৩ রাইফেল নিয়ে নিজেদের তৈরী করছে শত্রুর মোকাবেলার জন্য। এঘটনায় আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তাদের প্রস্তুতির ধরন দেখে আমার মনে হল যে কত বড় শত্রুর মোকাবেলা তারা করতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে একটা পরিস্কার ধারণা পর্যন্ত তাদের নেই। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটা নিয়মিত বাহিনীর মোকাবেলায় ৩০৩ রাইফেল নিয়ে বেসামরিক লোকদের পক্ষে কতটুকু কি করা সম্ভব! কিন্তু তবু সেদিন আমি ওদের প্রাণের আবেগ ও চিত্তের দৃঢ়তায় মুগ্ধ হয়েছিলাম।

 পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পাকিস্তান বিমান বাহিনীর টেকনিশিয়ানদের অধিকাংশই ছিলেন বাঙ্গালী। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা সে সময় আমি ভেবেছি। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ নেবার আগে রাজনৈতিক অনুমোদন সমীচীন মনে হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটা কার্যকর যোগযোগ স্থাপনের চেষ্টা করি। এই সূত্রে দু’জন আওয়ামী লীগ এমপি আমার বাসায় আসেন। আমি তাদেরকে বল্লাম যে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের তৎপাতা ও প্রস্তুতি দেখে আমার ধারণা হচ্ছে যে, তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এ অবস্থায় কি করণীয় জানতে চাইলাম এবং তাদের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙ্গালীদের