পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৯

ভূমিকা সম্পর্কে পার্টির নেতাদের মনোভাব জানবার ইচ্ছাও তাদের নিকট ব্যক্ত করলাম। সে মুহূর্তে তারা আমাকে সুনির্দিষ্ট কিছুই বলতে পারেননি।

 ২৫শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে এয়ারপোর্ট যাই। দেখলাম অতি গোপনে সতর্ক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একটি বিমানে মাত্র একজন কিংবা দু’জন যাত্রীসহ জেনারেল ইয়াহিয়া করাচীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করলেন। আমি এই সংবাদ টেলিফোনে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে জানিয়ে দিই। আমার মনে আছে, এয়ারপোর্ট থেকেই আমি ক্যাণ্টনমেণ্টে এয়ারফোর্সের সব বাঙ্গালী অফিসারদেরকে খবরটা দেয়ার চেষ্টা করেছি। পরে বাড়ী বাড়ী গিয়ে তাদেরকে আবার খবরটা বিস্তারিত দিই। বলেছি, পরিস্থিতি গুরুতর, একটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি তাদের সবাইকে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে বলি এবং আমার পরিবারকে ক্যাণ্টনমেণ্টের বাইরে পাঠিয়ে দিই।

 রাত এগারটার দিকে কানে আসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের আওয়াজ। পায়ের আওয়াজের পরপরই ট্যাঙ্ক চলার শব্দ। বুঝতে পারলাম যা একদিন আশঙ্কা করেছিলাম তা বাস্তবে পরিণত হতে শুরু করেছে। রাতভর সারা শহরজুরে যে তাণ্ডব চলছিল, আগুনের আলোতে এবং গুলির আওয়াজে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকেই ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা হচ্ছিল। কিন্তু তাণ্ডবের ভয়ঙ্কর রূপটা যে কল্পনার সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে, না দেখা পর্যন্ত সেটা সঠিক বোঝা যায়নি।

 ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা থেকে মাঝ রাতের ভেতরেই জনসাধারণ জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে পাক সেনাদের চলাচলে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে এসব ব্যারিকেড কোন বাধাই ছিল না।

 ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় এয়ার ফোর্স মেসে গেলাম। মেসের পাশে যে পুকুর তার পূর্ব দিক থেকেই নাখালপাড়া এলাকা শুরু। এটা অত্যন্ত গরীব ও নিম্নবিত্ত লোকের এলাকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম পাকবাহিনীর লোকেরা অগ্নিসংযোগকারী যন্ত্র নিয়ে পুরো এলাকাটি ঘিরে ফেলেছে এবং তাদের সাথে মেশিনগানধারী সৈন্যরা পজিশন নিয়েছে।

 অল্পক্ষণ পরেই দেখলাম সারা এলাকায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় মানুষ প্রাণের ভয়ে আর্তচীৎকার করে বেরিয়ে আসছে বাইরে। সারা শহরে তখন কার্ফু। এরা কার্ফু ভঙ্গ করেছে এই অজুহাতে সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগানধারী সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালাল।

 পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের মাঝে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে এই সব গরীব ও নিম্নবিত্ত লোকেরাই আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক ভিত্তি—সুতরাং এদেরকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে। মেসে জনৈত পাকিস্তানী ফ্লাইট লেফটেনাণ্ট যিনি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং জানতেন যে, আমি একজন বাঙ্গালী গ্রুপ ক্যাপ্টেন, আমার সামনে মন্তব্য করলেন—This is way to deal with the bastards.

 এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীতে কিভাবে যোগদান করা যায় সে কথা ভাবতে শুরু করি। কিন্তু কিভাবে যাবো? আমার বাসায় কয়েকজন গার্ড নিয়োগ করা হয়েছিল নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল আমার গতিবিধির ওপর নজর রাখা।

 কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশ ত্যাগের ব্যাপারে আমি অন্যান্য বাঙ্গালী আফিসার, বিশেষ করে বৈমানিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি। তখনকার উইং কমাণ্ডার বাশারের সাথেও আমি যোগাযোগ স্থাপন করি এবং তার মাধ্যমে অন্য অফিসারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি।

 আলাপ-আলোচনার পর আমরা এয়ার ফোর্সের কতিপয় অফিসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই যে যেমন করেই হোক পাক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতেই হবে। আমাদের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য