পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২২

লক্ষ্যে এবং একই কমাণ্ডে সমন্বিত হওয়া উচিত এবং এটাই আমরা চেয়েছিলাম। একজন রাজনীতি-নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে আমি অনুভব করতাম যে মুক্তিযুদ্ধ কোন একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সংগ্রাম নয়—এটা একটা জাতীয় জনযুদ্ধ।

 একাত্তরের আগস্ট মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়—এগুলোকে ‘জেড ফোর্স’; ‘এফ ফোর্স’ এবং ‘কে ফোর্স’ নামে আভিহিত করা হয়। এগুলো গঠন করার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যে ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণের ফলে পাক বাহিনী যখন দুর্বল ও হতোদ্যম হয়ে পড়বে তখন এই ব্যাটালিয়নগুলোর দ্বারা চূড়ান্ত আঘাত হেনে বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এলাকা সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করা হবে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঐ এলাকা থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং যুদ্ধ দুই-ই চালিয়ে যাওয়া হবে।

 এই ব্যাটালিয়নগুলো সেনাবাহিনী, বিডিআর এবং পুলিশ বাহিনীর যে সব নিয়মিত সৈনিক মুক্তিবাহিনীতে ছিল তাদের ভেতর থেকে গুণাগুণ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বাছাই করা যুবকদের নিয়ে গঠন করা হয়। তিনটি ব্যাটালিয়নে নেয়ার পর নিয়মিত বাহিনীর বাদবাকী সদস্যদের নিয়ে ‘সেক্টর ট্রুপস’ গঠন করা হয়। ব্যাটালিয়ন এবং সেক্টর ট্রুপসের সদস্যরাই সাধারণভাবে ‘মুক্তিফৌজ’ নামে অভিহিত হত। বাকী সকল নিয়মিত ও অনিয়মিত গেরিলা যোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বা ফ্রিডম ফাইটার নামে অভিহিত করা হত।

 ব্যাটালিয়ন এবং সেক্টর ট্রুপস গঠন করার ফলে এই বাহিনীর বাইরে একান্তভাবে গেরিলা তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য যারা রয়ে গেলেন তাদের বেশীর ভাগই ছিলেন অপেশাদার, অনভিজ্ঞ ও অতি সামান্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ফলে গেরিলাদের ছোট ছোট গ্রুপগুলোকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব প্রদানের অসুবিধা হয়ে পড়ে। এছাড়া ভারত যে পরিমান অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতো প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল একান্তই অপ্রতুল। ফলে সাময়িকভাবে গেরিলা বাহিনীর কার্যকারিতা বেশ কিছুটা হ্রাস পায়।

 গেরিলা যুদ্ধের ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণার অভাব এবং পরে উদ্ভূত এই পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য একটা কার্যকর পরিকল্পনা তৈরী অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে কর্নেল ওসমানীর অনুমতি নিয়ে আমি যে প্লান তৈরী করি তাতে যুদ্ধ পরিচালনায় দক্ষ একটা কমাণ্ড গঠন, মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতি অবলম্বন প্রশিক্ষণ ও পরিবেশের উন্নতি এবং সমন্বয় ও যোগাযোগের ব্যাপারে কর্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছিল।

 এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সরকারের এক কেবিনেট মিটিং-এ জেনারেল অরোরা এবং ডি পি ধরসহ বহু শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অধিকতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং যুদ্ধোপকরণ সরবরাহের দাবী জানানো হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতা দানের পূর্বশর্ত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় চরিত্র আরোপ এবং এর অর্থনৈতিক দিকগুলো তুলে ধরার পরামর্শ দেন।

 বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ন গঠন করার কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। একটা স্বাধীন দেশের পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রশ্নটিকে সামনে রেখে আমরা তখন বাংলাদেশের বিমান বাহিনী গড়ে তোলার কথাও চিন্তা করি। বিমান বাহিনীর প্রয়োজনীয়তাও তখন অনুভূত হচ্ছিল। আমি বিমান বাহিনী গঠনের ব্যাপার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ও কর্নেল ওসমানীর সাথে আলোচনা করি। এই আলোচনার ফলশ্রুতি হিসেবে পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের উপস্থিতিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা সচিব মি কে বি লাল এবং বিমান বাহিনীর এয়ার মার্শাল দেওয়ানের সাথে আমার আলোচনা হয়। তারা বল্লেন যে, আমাদের বৈমানিকদের ভারতীয় স্কোয়াড্রনের সাথেই অপারেট করতে হবে এবং স্বভাবতই ভারতীয় নিয়ম-কানুন আমাদের ওপর প্রযোজ্য হবে। আমি এই প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করে বিকল্প হিসেবে আমাদেরকে বিমান এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি