পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৭

অধ্যাপক আজিমদ্দিন।[১] ব্যবস্থা করা হলো যে, পাক-সেনাবাহিনীর আক্রমণে নওগাঁর নিরাপত্তা বিপন্ন হলে ইন্সপেক্টর লোদীর পরিবার আমার স্ত্রী, মেয়ে এবং ছেলেকে নিয়ে ধামুরহাট বর্ডার দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেবে। ১২ই এপ্রিল আমি সারদায় ফিরে আসি। তখন একাডেমি প্রায় জনশূন্য। ভাইস প্রিন্সিপাল শৈলেন্দ্র কিশোর চৌধুরীর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন বলে নিরুপায় হয়ে তারা সারদায় রয়ে গেছেন। পিএসপি ট্রেইনী অফিসারদের মধ্যে বাঙ্গালীরা নিজ নিজ বুদ্ধি খাটিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছুবার আশায় বের হয়ে গিয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের পদ্মার অপর পারে ভারতে পৌঁছিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে। আরো জানতে পারলাম যে, তারা ভারতীয় বর্ডার নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে রিপোর্ট করেছে।[২] জনশূন্য একাডেমিতে থাকার কোন যৌক্তিকতা নেই দেখে রশীদ ও আমি ঠিক করি যে, ১৪ই এপ্রিল সন্ধ্যায় চারঘাট হয়ে কুষ্টিয়ার পথে ভারতে প্রবেশ করব। এদিকে ঢাকা থেকে মাঠঘাট পুড়িয়ে জ্বালিয়ে পাক বাহিনীর নাটোরে এসে পৌঁছেছে। গুপ্তচরেরা আমাদের অবস্থান ওদেরকে জানিয়ে দেবে এই বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহ ছিল না। দুটি রাত সারদার বাইরে চারঘাট থানাঘরে কাটাই। থানায় কেউ ছিলনা। শুধু আমি এবং সারদার একজন বাঙ্গালী সিপাহী। ১৪ই এপ্রিল বিকাল চারটায়, সঙ্গে কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে সারদা থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরী হচ্ছি ঠিক এমনি সময় মেশিনগানের বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। মিনিট খানেকের মধ্যে খবর পেলাম যে পাক বাহিনী তিন দিক থেকে একাডেমি ঘেরাও করেছে এবং অফিসারর্স মেসে পৌঁছেছে। মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে সব কিছু ফেলে পদ্মার দিকে দৌড়ে পালাই। পানির ধারে কিছুসংখ্যক স্থানীয় লোক সামরিক বাহিনীর দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে আছে। নদী পার হবার কোন যানবাহন আনেকদিন আগে থেকেই সেখানে নেই। সাঁতরিয়ে পার হবার জন্য পানিতে নেমেছি, পিছনে তাকিয়ে দেখতে পাই নিকটবর্তী চরের নালায় একটি ছোট ঘাসের নৌকায় কয়েকজন লোক উঠবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঐ সময় নদীতে এগোলেই মাঝি গুলি খেয়ে মরবে এই ভয়ে বুড়ো মাঝি কাউকে নৌকাতে উঠতে দিচ্ছে না। ঘাস ভর্তি ছোট নৌকাটিতে বড়জোর দু’জন উঠতে পারে। আমি চরে ফিরে আসি এবং নৌকার কাছে গিয়ে মাঝিকে অনুরোধ জানাই আমাকে ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে চরের ধার বেয়ে কিছুদুর নিয়ে যাবার জন্য। সৈন্যদের চোখে ধূলি দিয়ে পালাবার আর কোন বুদ্ধি সে সময় মাথায় আসেনি। আমাকে ঘাসের নীচে লুকিয়ে নৌকাটি ধীর গতিতে নদীর চরের ধার বেয়ে চলেছে তাতে কারো সন্দেহ হয়নি যে নৌকাটিতে আমি পালাচ্ছি। এভাবে একাডেমির গণ্ডির বাইরে এসে নৌকাটি সরাসরি নদী পার হবার পথে এগিয়ে চলে এবং দ্রুত বেগে অনেক দূরে এসে পৌঁছে। এ সময় সামরিক হেলিকপ্টার থেকে আগুন ছেড়ে গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। দিশেহারা হাজার হাজার লোক পালিয়ে পদ্মা নদীর চরে এসেছে কিন্তু নদী পার হতে পারছেনা। এদের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার লোককে নদীর ধারে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে মাত্র চার/পাঁচ শত গজ দূরে উক্ত ঘাসের নৌকা ও আমি। সৈন্যরা ভাবতে পারেনি যে, আমি সেই নৌকায় লুকিয়ে আছি। ঘণ্টাখানেক পর পদ্মার অপর পারে পৌঁছি। সঙ্গে কিছু নেই। ভেজা প্যাণ্ট ও শার্ট। নওগাঁয়ে ফেলে আসা পরিবারের কি অবস্থা ভাবতেই পারছিলাম না। হাজারো দুশ্চিন্তায় একেবারে ভেঙ্গে পড়ি। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আজো স্মরণ করছি যে সারদায় গিয়ে আমি একটি ৬০০পৃষ্ঠাব্যাপী বই-এর পাণ্ডুলিপি তৈরী করেছিলাম। এই পাণ্ডুলিপি সারদা একাডেমির ষ্টেনোগ্রাফার শহীদ মোস্তফার হাতেই তৈরী হয়। আমি যেদিন সারদা ছেড়ে পালিয়ে যাই সেদিনই মোস্তফাকে পাক সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে। আমার বাড়ীঘর, পাণ্ডুলিপি সবকিছূ লুষ্ঠিত হয়।

 ১৪ই এপ্রিলের সকাল বেলা সারদা একাডেমির ভাইস-প্রিন্সিপাল শৈলেন্দ্র কিশোর চৌধুরীকে পরিবারসহ পদ্মার ওপারে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করা হয়। অনেক অনুরোধের পর স্থানীয় লোকজন তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর প্রতি সদয় হয়ে কোনক্রমে একটি নৌকা যোগাড় করে দেয়। নদীর ওপারে পৌঁছে চৌধুরী চরেই পরিবারসহ বসে থাকে। তার স্ত্রীকে নিয়ে এগোতে সাহস পায় না। সন্ধ্যার পরক্ষণেই আমরা ভারত সীমান্তে ডাক্তার নরেন্দ্র নাথের


  1. আজিমুদ্দিন পাক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হন, আর নাজমুল হক সীমান্তের ওপারে যুদ্ধ প্রস্তুতির সময়ে জীপ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। ক্যাপ্টেন রশীদ আজ আর বেঁচে নেই।
  2. উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাদেরকে ভারতে আটকে রাখা হয়। যুদ্ধের পরবর্তী কোন এক সময়ে তাদের পাকিস্তানে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করা হয়।