পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩৪

একাজ করেছে। আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে দেশপ্রেমিক মানুষের বাড়ীতে লুকিয়ে পালিয়ে রাত কাটিয়েছে। যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিল তারাও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আর যারা আমাদের গোয়েন্দাদেরকে খবর দিয়ে সাহায্য করেছিল তাদেরকে কি আমরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলবো না? ষ্টেট ব্যাংকের যে সব সিরিজের নোট খোয়া গিয়েছিল সে সব সিরিজের তালিকাও আমাদের লোকজন সংগ্রহ করেছিল। এই সুদক্ষ গোয়েন্দার কাজে প্রধানতঃ পুলিশ, ছাত্র ও বেসামরিক সরকারী কর্মচারীরা নিয়োজিত ছিল।

 দেশত্যাগী প্রায় সাত হাজার পুলিশ, এবং পাঁচ হাজার ই পি আর স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছে। পুলিশদেরকে ১৭০০ মাইল সীমান্তের আশ্রয় ক্যাম্প ও অন্যান্য জায়গা থেকে খুঁজে বের করে সংঘবদ্ধ করার কাজ আমাকে করতে হয়েছে। ই পি আর-এর প্রায় সকলেই নিয়মিত বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত ছিল। পুলিশের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। সীমান্তের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত ছিল বলে ই পি আর ছিল আমাদের অভিযানের সেরা সৈনিক। ই পি আর ও পুলিশ অকাতরে যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন দিয়েছে। প্রায় ষোলশত পুলিশ এবং এক হাজার ই পি আর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। পংঙ্গু হয়েছে অনেকে। পরিবারের উপর বহু রকম নির্যাতন চালিয়েছে পাকবাহিনী। বাংগালী সৈনিক ও অফিসারদের অনেককেই যুদ্ধের আগে থেকে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল বলে মুক্তিযুদ্ধে পেশাগত সৈন্যের সংখ্যা খুব বেশী ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানে যারা আটক ছিলেন বন্দী শিবির থেকে কেউ কেউ পালিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।

 স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় ভূমিকা কারো কারো কাছে ছিল বিতর্কিত। নিজস্ব শক্তিতে শুধু ত্যাগ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ও মনোবলকে সম্বল করে সুদক্ষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভবপর হবে কিনা এই প্রশ্নে আমাদের সামরিক মহলে মতভেদ ছিল। কর্নেল ওসমানীর ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আমাদের তরুণ সামরিক অফিসারদের কিছুটা গরমিল ছিল। বাইরের কারো নেতৃত্বের গুরুভারে মুক্তিবাহিনীর গৌরব ক্ষুণ্ণ হবে এ ধারণা অনস্বীকার্য হলেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে দীর্ঘকালীন করার বিপক্ষে প্রশাসনিক মতামত ছিল সুস্পষ্ট। পাক বাহিনীর দীর্ঘকালীন নির্যাতনে দেশবাসী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই ভয়ে যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করার বিপদকে দেখা হয়েছে বাস্তবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রকে আমরা ভয় করেছি। মুজিব বাহিনীর সৃষ্টিতে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভেদের দানা গড়ে উঠেছিল প্রায়। ছাত্র নেতারও ইতিমধ্যে মতবিরোধের শিকার হয়েছিল। কাজেই সংক্ষিপ্ততম সময়ে বিজয় অর্জন করতে হবে—এই ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে ভারত আমাদেরকে সাহায্য করেছে। মুক্তিবাহিনীকে যথাসম্ভব সঙ্গে নিয়ে চূড়ান্ত অভিযান চালানো হয়। পশ্চিম রণাঙ্গনের পাক-ভারত যুদ্ধে আমাদের তেমন আকর্ষণ ছিল না। পাকিস্তান পরাজিত হবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের রণাংঙ্গনে কত শীঘ্র পাকিস্তানকে পরাজিত করা যাবে এটাই ছিল আমাদের কাম্য।

 ভারতীয় যুদ্ধবিশারদরা ‘বাইপাস’ সিস্টেম-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব নূন্যতম সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। ‘বাইপাস’ সিস্টেম এ পাকবাহিনীকে কোন সম্মুখযুদ্ধের সুযোগ দেয়া হয়নি। লক্ষ লক্ষ মুক্তিবাহিনী ভারতীয় নেতৃত্বে পাক বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। দিশেহারা পাক বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র যেখানে-সেখানে ফেলে ঢাকায় এসে আত্মসমর্পণের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়। বাংলাদেশের কোথাও লুকিয়ে জীবন বাঁচাবার পরিস্থিতি তাদের ছিল না। সপ্তম নৌ-বহরের পাঁয়তারা সত্ত্বেও প্রায় একলক্ষ পাক বাহিনীর এত নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ!

 বিজয় যখন দিবালোকের মত স্পষ্ট, তখন আত্মসমর্পণ উৎসবে আমাদের যোগদান সম্পর্কে যে কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় তাতে স্থির করা হয়েছিল ১৬ই ডিসেম্বর কর্নেল ওসমানী, রুহুল কুদ্দুস ও আমি হেলিকপ্টারে ভারতীয় কমাণ্ডারকে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছুব। দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছুবার জন্য আমাদের যে সময় দেয়া হয়েছিল তার ঘণ্টাখানেক পূর্বে আমাদের প্রশাসনে কি যেন একটা হাস হাস পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আমি তার কিছুই আঁচ