পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩৯

কলকাতায় ফিরি। তার পূর্ব থেকেই আমাকে কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসনের এম,এন,এ ইনচার্জ করে বিধান রায়ের বাড়ী ৪৭ প্রিন্সেপ স্ট্রীটে দফতরের ভার দেয়া হয়। অধ্যাপক ইউসুফ আলীকেও পরে যুক্তভাবে এই পদে একই জায়গায় নিয়োগ করা হয়। পরে পরিচয়পত্র প্রদান ইত্যাদি ব্যাপারে কাজের চাপ অসম্ভব বেড়ে যাওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান তাঁর মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে নেন। সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের আরো দুইটি অতিরিক্ত অফিস নেয়া হয়। একটি ৩/১ কামাক স্ট্রীটে এবং অন্যটি ১নং বালিগঞ্জে। শ্রী জি, এস ভৌমিক Defected জিলা দায়রা জজকে রিলিফ কমিশনার হিসেবে আমার অধীনে ন্যস্ত করা হয়। জনাব কাওসার আলীসহ অনেকে যুক্তভাবে আমাকে সহায়তা করেন। প্রবাসী মুজিবনগর সরকার ৯ মাস যুদ্ধকালে আর কোন মন্ত্রী নিয়োগ করেননি। আমাদের এম,এন, এ ইনচার্জদের মন্ত্রীর স্ট্র্যাটাস দেয় হয়। ৩/১ কামাক স্ট্রীটে বিদেশ হতে প্রাপ্ত টাকা, চেক ইত্যাদি গ্রহণ করা হতো। এখানে জনাব কামরুজ্জামান, ইউসুফ আলী এবং আমি ছাড়া আর কোন লোকের প্রবেশাধিকার ছিল না।

 পরে মাননীয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আমাকে তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিনিধি (Personal envoy) হিসেবে মনোনীত করেন এবং জুন মাসে বিভিন্ন রণাঙ্গনে, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ও নেপালে সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে ঘোষণা করেন। পালাটোনায় ক্যাপ্টেন সুজাত আলী, এম, এন, এ ও ভারতীয় ক্যাপ্টেন ধর আমাকে নিয়ে প্রায় দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধার শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। মেলাঘরে প্রায় ৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা আমার হাতে শপথ গ্রহণ করে। মেজর খালেদ মোশারফ, ক্যাপ্টেন হুদা, মেজর হায়দার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনুরূপভাবে আমি রাজনগর, ধর্মনগর, ছোতাখোলা, বিলোনিয়া, বেগুলা, মাঝদিয়া, চরিলাম, সাবরুম, পূর্বাঞ্চলীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও করিমপুর, শিকারপুর, ইছামতি ভাগিরতীর তীরে অবস্থিত বহু ক্যাম্পে গমন করি এবং বিভিন্ন সেক্টর কমাপ্তর ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা, অস্ত্রশস্ত্র ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থা করি। উল্লেখ্য যে, আমাদের বহু খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধা দেশের অভ্যন্তরে থেকেই সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। জনাব রুহুল আমিন ভুঞা, খালেদ মোহম্মদ আলী এম এন এ, মাহমুদুর রহমান, বেলায়েত ও আমার দুই ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন ও বাহার উদ্দিনসহ এরা প্রায় ৯ মাস দেশের অভ্যন্তরেই ছিলেন।

 ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করার পরই আমি কিছু নগদ টাকা ও দুই ট্রাক ত্রাণ সামগ্রী যথা রেইন কোট, কিটস ইত্যাদি নিয়ে আগরতলায় এসে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিতরণ করি। জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৬৩ জন এমপি এ, এম এন এ-র উপস্থিতিতে আমার সভাপতিত্বে পূর্বাঞ্চলীয় সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ইতিপূর্বে এ পদ নিয়ে খুব দলাদলি ও দ্বন্দ্ব ছিল। ইতিমধ্যে আমি নিজের কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী আনয়ন ও পরিবারের স্ত্রী, মাতা, ৫মেয়ে ও ২ছেলে সকলের খোঁজ-খবর নেয়া এবং নোয়াখালী জেলার সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ২৪শে এপ্রিল বেলুনিয়া হয়ে নোয়াখালী প্রবেশ করি। মাইজদী গিয়ে দেখি বাসা ফাঁকা, সব মালপত্র আছে কিন্তু বাড়ীতে কোন মানুষ নেই। অনুরূপভাবে জিলা প্রশাসক, জজ, পুলিশ সুপার সকলেই নিজ নিজ বাসস্থান ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ হানাদার বাহিনী লাকসাম হয়ে রেল লাইন ধরে দ্রুত নোয়াখালীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। গভীর রাতে আমি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে শুধু ঘণ্টাখানেকের জন্য আমার স্ত্রী, বড় মেয়ে ও শ্বশুরবাড়ীর লোকজনদের সাথে দেখা করি। সঙ্গে সঙ্গেই একটি জীপ ঐ বাড়ীতে আসে এবং রিজার্ভ পলিশের ইন্সপেক্টর মিঃ খান এসে বলেন স্যার, এখনই আপনাকে চলে যেতে হবে, কাল আর বর্ডার ক্রস করতে পাবেন না। হানাদার বাহিনী মাইজদী টাউন হতে মাত্র ১০/১৫ মাইল দূরে চৌমুহনীর উত্তরে অবস্থান নিয়েছে। কাজেই ঐ মুহূর্তে হতভম্বের মত আবার নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করলাম। সঙ্গে ছিল আমার ল্যাণ্ড রোভার জীপ আর ড্রাইভার মাহমুদ, চৌমুহনী বিদ্যামন্দিরের হেডমাষ্টার সালাউদ্দিন এবং সোনাইমুড়ীর গোলাম মোস্তফা। সামান্য কিছু টাকা নিয়ে আঁকাবাঁকা পথে ২৫শে এপ্রিল বর্ডার ক্রস করে বেলুনিয়া পৌঁছি। আসার সময় স্ত্রীকে বলে আসি “খোদা হাফেজ, চরাঞ্চলে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে চেষ্টা করো।“বর্ডারের কাছে এসে এক নিরাপদ স্থানে জনাব